রামাদ্বানের মাঝেই অন্তর্নিহিত সময় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি
সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নিয়ম,পদ্ধতি, আয়োজন এবং কৌশলের আধিক্য থাকলেও শ্রেষ্ঠ উপায়টা সাধারণত হয় সহজতমটা। সকল কাজগুলোর একটা শিডিউল/অনুসূচি বানানো আসলে সময়ের সদ্বব্যবহার করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। এজন্যই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ এটা করে থাকে।যখন আপনাকে একটি নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুসরণ করতে হয়, তখন কাজগুলো হয়ে যায়। সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার চরম ঘাটতি রয়েছে যার কারণে পড়া বা কাজের মত করে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনটাকেও আমরা একটা কার্যক্রমের মত করে সাজাতে পারি না। আল্লাহ রামাদ্বানের মাঝে এমন একটি শিডিউল সৃষ্টি করেছেন যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন শৃঙ্খলা আনয়ন করে যাতে অনেক কাজ করে ফেলা যায়।
রামাদ্বান শিডিউল: রামাদ্বানে দৈনন্দিন যে কাজগুলো করা বাঞ্ছনীয়, তার অভ্যাস আমাদের একটা কাঠামো দেয় যার আলোকে আমরা আমাদের দিনের পরিকল্পনা করতে পারি। নিচে আমি একটা ধারণা দিচ্ছি যে কিভাবে আমরা এই সময়গুলো কাজে লাগাতে পারি-
কোন ধর্মীয় দিক নির্দেশনা দেয়া এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। ইবাদাতের ব্যাপারে যে পরামর্শ দিচ্ছি তা আমার সীমিত জ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভ্যাসের উপর ভিত্তি করে দেয়া। বিস্তারিত বা ব্যাখ্যা এবং সবচেয়ে প্রশংসনীয় ইবাদাত কার্যের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট জ্ঞানের জন্য যোগ্য এবং বিশ্বস্ত স্কলারদের সাথে আলোচনা করার অনুরোধ করছি।
সেহরি: প্রথমেই, রোযা শুরু করার আগে কিছু খাওয়ার (যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ) জন্য আমাদের অধিকাংশকে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশ আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। যদি আগে থেকেই অভ্যাস না থেকে থাকে, তাহলে এটা আমাদের সুযোগ দেয় তাহাজ্জুদ পড়ার, যার সওয়াব অফুরন্ত।
ফজরের সালাত: ছেলেদের জন্য, অধিকাংশ মসজিদই তাদের জামাতের সময় এমনভাবে সমন্বয় করে যাতে ফজরের সালাত জামাতে আদায়ের জন্য তাদের সেহরির পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে না হয়। সাধারণত নামাযের মাঝে ৩০ মিনিটের একটা বিরতি থাকে যেটা জিকির বা কুরআন তিলাওয়াতে নিমগ্ন হওয়ার জন্য আদর্শ। আপনার স্থানীয় মসজিদের নামাযের সময় খেয়াল করুন; জামাতের সময় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হয় এবং হয়ত বা বিকল্প কোনো মসজিদের ফজরের জামাতের সময় আপনার শিডিউলের জন্য বেশি উপযুক্ত হবে। মহিলারা যারা বাসায় নামায পড়ছেন, তাদের যেহেতু জেগে থাকতেই হয়, সেহেতু ফজরের পরে ১০-৩০ মিনিট একনিষ্ঠ ইবাদাতে কাটাতে পারেন।
সূর্যোদয়: আরেকটা খুব প্রশংসনীয় সুন্নাত হল ফজরের পর থেকে সূর্যোদয়ের মোটামুটি ২০ মিনিট পর পর্যন্ত বসে বসে জিকির করা এবং তারপর ইশরাকের সালাত পড়া। কারো যদি পড়া বা কাজে যাওয়ার তাড়া না থাকে, তাহলে ( কারো কারো জন্য এবারের রোযা গ্রীষ্মের ছুটির মাঝে পড়ছে) তাহলে আপনার উচিৎ এটাকে একটা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করা।তবে যদি সকালে কাজের জন্য যেতে হয়, তাহলে এটা খুব কঠিনও হতে পারে। যেমন ধরুন, যুক্তরাজ্যের লেসিস্টারে রাত ২.৩০টার দিকে সেহরির এবং তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে হয়, ৩০-৪০ মিনিটের জন্য ইবাদাত করে ফযর পড়তে হয় ৩টায় তারপর জেগে থাকতে হয় সকাল ৬টা পর্যন্ত।
তাই ফজর এবং ইশরাকের সালাত বিষয়ক ইস্যুর কোনো সহজ সমাধান নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নামাযের সময় বিভিন্ন হয়, তাই আপনাকে এমন একটি ঘুমের শিডিউল বের করে নিতে হবে যাতে আপনি জেগে থাকতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে, স্কলারদের সাথে আলোচনার পর আমি তাহাজ্জুদ এবং ফজরের সামায জামাতে পড়াকে অগ্রাধিকার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তারপর ঘুমাই এবং কাজের জন্য স্বাভাবিক সময়ে উঠি (৮টা-৯টার দিকে), তারপর সালাতুত দুহা পড়ি। এই সালাত সওয়াবের দিক থেকে ইশরাকের মতই এবং এভাবে আমার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
মাগরিব এবং ইফতার: ইফতার এবং মাগরিবের ঠিক আগের মূহুর্ত ইবাদাতের জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষিত, বিশেষ করে দুআ। এই সময়ে মসজিদ্গুলোতে একটা দারুণ দৃশ্য দেখা যায়, আর তা হল লাইন ধরে স্থানীয়দের আকুল তিলাওয়াত, জিকির এবং দুআতে নিমগ্ন থাকা। এই সময়টাতে ব্যক্তিগত কিছু বা জরুরী কাজের জন্য সময় দেয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত যেহেতু এর উপর কিছুটা হলেও আপনার নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। অতিথি বা আমন্ত্রণকারী কর্তৃক ইশার জামাত এবং তারাবীহ পড়া থেকে বিরত রাখার প্ররোচনা আপনাকে প্রতিহত করতে হবে।আসলে আমাদের যে তারাবীহ নামায আছে, সেটাই আমাদের একটা আদর্শ সময় কাঠামো দেয়।
তারাবীহ: যদিও বাধ্যতামূলক নয়, তারপরও মসজিদে জামাতে তারাবীহ পড়ার বহু উপকারিতা আছে- তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হল পুরো কুরআনের তিলাওয়াতটা নামাযে শুনতে পারা আর একতাবদ্ধতার অনুভূতি উদ্রেককারী এক চমৎকার পরিবেশ ।বোনদের উচিৎ স্থানীয় সুবিধা অনুসন্ধান করা যেহেতু অধিকাংশ শহরই তাদেরকেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।
ই’তিকাফ: রোযার শেষ দশ দিন মসজিদে শুধুমাত্র ইবাদাতের জন্য উৎসর্গ করা আল্লাহ্র কাছাকাছি যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ সময় বের করার ক্ষেত্রে এক অদ্বিতীয় পদ্ধতি।যেহেতু এটা হাজ্জের মত যাতে লম্বা সময়ের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, তাই আমাদের অনেকের জন্য এটা জীবনের মাত্র অল্প কয়েকবারই করা সম্ভব। কিন্তু ব্যাপারটি এমন হবার প্রয়োজন নেই।বছরের পর বছর ধরে আমি দেখেছি কিভাবে বন্ধুরা অগ্রবর্তী হয়ে তাদের কাজ এবং ছুটির সময়ের মাঝে সমন্বয় করেছে যেন তারা বাৎসরিকভাবে এই অসাধারণ ইবাদাতে লিপ্ত হতে পারে। আপনি যদি করতে চান, ব্যবস্থা তাহলে একটা হবেই। এবং একবার যদি আপনি এর উপকারিতার স্বাদ পান, তবে বারবার এটার অভিজ্ঞতা নিতে চাইবেন। সময় ব্যবস্থাপনার উপর পুরো অধ্যায়টাই কথা বলে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে- ফোন কল, ই-মেইল, অযাচিত অতিথি, পোস্ট ইত্যাদি। আর ই’তিকাফের নিয়মটাই হচ্ছে এমন যাতে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসৃত হয়।আজকের আধুনিক যুগ, যা নিয়ত প্রতিবন্ধকতা আবহে পরিবেষ্টিত,সেই সময়ে এই বিশৃংখল ছুটে চলা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হবার এক অবিশ্বাস্য পদ্ধতি এই দশ দিনের ই’তিকাফ।