ঈমান বিল্লাহ বা আল্লাহর প্রতি ঈমান বলতে কী বুঝায়

 গ্রন্থের নামঃ ইসলাম কিউ এ ফতোয়া সমগ্র
 বিভাগ/অধ্যায়ের নামঃ আকীদা
 লেখক/সংকলক/অনুবাদকঃ শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ



 ঈমান বিল্লাহ বা আল্লাহর প্রতি ঈমান বলতে কী বুঝায়। 

প্রশ্নঃ আল্লাহ্‌র প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান বাস্তবায়নের ফজিলত সম্পর্কে আমি প্রচুর পড়েছি, অনেক শুনেছি। আল্লাহর উপর ঈমান আনা বলতে কী বুঝায়; তা যদি একটু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন যাতে আমি পূর্ণ ঈমান বাস্তবায়ন করতে পারি এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীবর্গের আদর্শ বিরোধী সবকিছু থেকে দূরে থাকতে পারি।
 
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের জন্য।
আল্লাহ্‌র উপর ঈমান আনার অর্থ হলো- “তাঁর অস্তিত্বের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। কোন সন্দেহ সংশয় ছাড়া  বিশ্বাস স্থাপন করা যে- তিনি একমাত্র প্রতিপালক (রব্ব), তিনি একমাত্র উপাস্য (মাবুদ) এবং তাঁর অনেকগুলো নাম ও গুণ রয়েছে।” সুতরাং আল্লাহ্‌র উপর ঈমান চারটি বিষয়কে শামিল করে। যে ব্যক্তি এই চারটি বিষয়কে বাস্তবায়ন করবে, তিনি প্রকৃত মুমিন হিসেবে বিবেচিত হবেন।  
প্রথমত: আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের প্রতি ঈমান আনা: ইসলামী শরিয়তের অসংখ্য দলীল যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করে তেমনি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও সাধারণ প্রবৃত্তি দ্বিধাহীনভাবে আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের প্রমাণ সাব্যস্ত করে।  
১. আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের ব্যাপারে মানব ফিতরতের বা প্রবৃত্তির প্রমাণ: প্রতিটি সৃষ্টিই স্বপ্রণোদিতভাবে তার স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী হবে -এটাই যৌক্তিক। এ জন্য সুগভীর চিন্তা বা সুদীর্ঘ গবেষণার কোন প্রয়োজন নেই। সৃষ্টিমাত্রই এ স্বাভাবিক সুস্থ প্রবৃত্তির উপর টিকে থাকবে, যতক্ষণ না তার অন্তরে এমন কোন ভ্রষ্টতা প্রবেশ করে, যা তাকে এ থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এ জন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “প্রতিটি নবজাতক তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তির উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় বা অগ্নিপূজক বানায়।”[বুখারী, ১৩৫৮ ও মুসলিম, ২৬৫৮] 
২. আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের ব্যাপারে মানুষের বিবেক-বুদ্ধির প্রমাণ: বিবেকবানমাত্রই বুঝতে পারে যে, পৃথিবীর আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত যত মাখলুকাত অতিবাহিত হয়েছে বা হবে এদের একজন স্রষ্টা থাকতেই হবে। না থেকে কোন উপায় নেই। কেননা, কোন সৃষ্টি যেমন নিজে নিজেকে অস্তিত্ব দিতে পারে না, তেমনি দৈবক্রমে অস্তিত্বে আসাও সম্ভব নয়। সে নিজে নিজেকে অস্তিত্ব দিতে পারবে না। কারণ কোন বস্তুই আপনাকে সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না। অস্তিত্বে আসার আগে যে নিজে অস্তিত্বহীন ছিল, সে কিভাবে স্রষ্টা হবে? অনুরূপভাবে দৈবক্রমে হয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। কেননা প্রতিটি ঘটনার, প্রতিটি কর্মের পেছনে একজন কর্মকার থাকে। সর্বোপরি, এমন সুকৌশল-সুশৃঙ্খল-সুনিয়ন্ত্রিত-সুসামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতিতে পৃথিবী সৃষ্টি ও মানবজাতির আবির্ভাব এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, এটি হেলাফেলায় আপনাআপনি হয়নি। আপনাআপনি বিশৃঙ্খলভাবে অস্তিত্বে আসাই তো কোন কিছুর পক্ষে সম্ভব না, আর এভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে টিকে থাকা তো বহুদূরের কথা। সুতরাং সৃষ্টি যখন নিজে নিজেকে অস্তিত্ব দানের ক্ষমতা রাখে না, আপনাআপনি হয়ে যাওয়াও যখন অবাস্তব, তখন একথাই প্রমাণিত হয় যে, একজন অস্তিত্বদানকারী আছেন। আর তিনি হলেন, “আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন।” 
এই বুদ্ধিবৃত্তিক অকাট্য প্রমাণ বর্ণনায় আল্লাহ্ নিজে ইরশাদ করেন, “তারা কি স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয়েছে? নাকি তারা নিজেরাই স্রষ্টা?” [সূরা তুর ৫২:৩৫] অর্থাৎ তারা স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয়নি এবং তারা নিজেরা নিজেদেরকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং এ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য জুবাইর ইবনে মুতয়িম যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সূরা তূরের এ আয়াতগুলো পড়তে শুনলেন- “তারা কি স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তারা নিজেরাই স্রষ্টা? তারা কি আকাশমণ্ডল  পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা তো অবিশ্বাসী তোমার প্রতিপালকের ধনভাণ্ডার কি তাদের নিকট আছে? না কি তারা এর নিয়ন্ত্রক? “[সূরা তূর ৫২:৩৫-৩৭] তখন তিনি মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও বলে উঠলেন: “আমার হৃদয় যেন উড়ে যাবে। এ আয়াতগুলো আমার অন্তঃকরণে প্রথম ঈমানের আলো জ্বালিয়ে তুললো।”[বুখারী কয়েকটি স্থানে হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন] 
একটি উদাহরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারব- “আপনার কাছে এসে কেউ একজন একটি সুরম্য অট্টালিকার গল্প করলো। যার চারদিকে পুষ্পশোভিত বাগান, পাদদেশে বইছে নয়নাভিরাম নহর, খাট-পালঙ্ক-গালিচায় সে উদ্যান সুসজ্জিত, সৌন্দর্য সেখানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর বলল, এই যে অট্টালিকা, আর তার চারপাশের যাবতীয় সাজসজ্জা সব কিন্তু নিজে নিজে হয়েছে। কেউ এগুলো তৈরী করেনি। এ কথা শুনলে আপনি নিঃসন্দেহে লোকটিকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবেন এবং তার এ দাবীকে হেসে উড়িয়ে দিবেন। তাই যদি হয়, তবে কিভাবে এ কথা মেনে নেয়া সম্ভব যে - এ সুবিশাল মহাবিশ্ব, আকাশমণ্ডল, গ্রহ-নক্ষত্র-তারকারাজি, এত নিখুঁত এত নিপুণ সবকিছু কোন একজন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আপনাআপনি তৈরী হয়েছে? 
এক মরুচারী বেদুঈনের মাথায়ও স্রষ্টার অস্তিত্বের এ যুক্তিনির্ভর প্রমাণটি অবলীলায় খেলে গিয়েছিলো। দ্বিধাহীন চিত্তে সে এটি প্রকাশ করেছে। যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “কিভাবে তুমি তোমার রব্‌কে চিনলে?” সে বললো, “উটের বিষ্টা দেখে আপনি বুঝে নেন যে এ পথে উট হেঁটেছে। পায়ের চিহ্ন দেখে আপনি বুঝে নেন যে, এ পথে কেউ একজন চলেছে। তাহলে স্তরে স্তরে সাজানো আকাশ, দেশ-মহাদেশে বিভক্ত জমিন, তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্র…এগুলো কেন প্রমাণ করবে না যে, একজন সর্বদ্রষ্টা সর্বশ্রোতা মহান সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছেন। 
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ্‌র কর্তৃত্ব ও প্রতিপালকত্বে বিশ্বাস স্থাপন: অর্থাৎ এ বিশ্বাসে অটল থাকতে হবে যে, আল্লাহ্‌ একমাত্র রব, একমাত্র প্রতিপালক। এই মহাবিশ্ব পরিচালনায় তার আর কোন অংশীদার বা সহযোগী নেই। 
রব (رب) বলা হয় তাঁকে যিনি সৃষ্টি করেন, পরিচালনা করেন এবং মালিকানা যার জন্য। সুতরাং – আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন স্রষ্টা নেই। আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন মালিক নেই। তিনি ছাড়া আর কোন বিশ্ব পরিচালকও নেই। পবিত্র কোরানে অনেক জায়গায় এ ঘোষণা বারবার উচ্চারিত হয়েছে - “জেনে রাখুন, সৃষ্টি করা ও হুকুমের মালিক তিনি।” [সূরা আ’রাফ ৭:৫৪] “বলুন! তিনি কে, যিনি আসমান ও জমিন হতে তোমাদেরকে রিজিক পৌঁছিয়ে থাকেন? অথবা কে তিনি, যিনি কর্ণ ও চক্ষুসমূহের উপর পূর্ণ অধিকার রাখেন? আর তিনি কে, যিনি জীবিতকে মৃত থেকে আর মৃতকে জীবিত থেকে বের করে আনেন? আর তিনি কে, যিনি সমস্ত কার্যাদি পরিচালনা করেন? অবশ্যই তারা বলবে যে তিনি একমাত্র আল্লাহ্‌। সুতরাং আপনি বলুন, তবে কেন তোমরা তাঁকে ভয় করছ না।[সূরা ইউনুছ ১০:৩১] তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সকল কার্য পরিচালনা করেন। তারপর তা একদিন তাঁর কাছেই উঠবে।”[সূরা হা-মীম সেজদা, ৩২:০৫] তিনিই আল্লাহ্‌, তোমাদের প্রতিপালক সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই আর তোমরা আল্লাহ্ পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো, তারা তো খেজুর আঁটির উপরে পাতলা আবরণ বরাবর (অতি তুচ্ছ কিছুরও) মালিক নয়”[সূরা ফাতির ৩৫:১৩]  
একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন। সূরা ফাতিহায় আল্লাহ্‌ বলেছেন, (مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ) অর্থাৎ তিনি বিচার দিবসের মালিক। অন্য ক্বেরাতে এসেছে (مَلِكِ يَوْمِ الدِّينِ) অর্থাৎ “তিনি বিচার দিবসের রাজা বা বাদশাহ।” এই দুটি ক্বেরাতকে যদি আপনি একত্রিত করেন তাহলে চমৎকার একটি তাৎপর্য বেরিয়ে আসবে। রাজত্ব ও কর্তৃত্ব বুঝাতে “مَالِكِ” (অধিকর্তা) শব্দের চেয়ে “مَلِكِ” (রাজা) শব্দটি বেশী প্রাঞ্জল ও অর্থবোধক। কিন্তু কখনো কখনো “مَلِكِ” (রাজা) দ্বারা শুধু নামসর্বস্ব কর্তৃত্বহীন রাজাকেও বুঝানো হয়। অর্থাৎ সে “مَلِكِ” বা বাদশাহ-ই কিন্তু তার হাতে কোন কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা না থাকায় তাকে “مَالِكِ” বা অধিকর্তা বলা যায় না। এজন্য দুই ক্বেরাতের “مَالِكِ” ও “مَلِكِ” শব্দদ্বয় একত্র করলে আল্লাহ্‌র জন্য রাজত্ব ও কর্তৃত্ব দুটোই নির্ধারিত হয়ে যায়। 
তৃতীয়তঃ আল্লাহ্‌র উপাস্যত্বে বিশ্বাস স্থাপন:
অর্থাৎ মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করতে হবে যে- আল্লাহ্‌ই একমাত্র ইলাহ্‌ তথা সত্য উপাস্য। উপাসনা প্রাপ্তিতে আর কেউ তাঁর অংশীদার নয়। ইলাহ্‌ (الاله) অর্থ হলোঃ সম্মান ও বড়ত্বের কারণে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় যার উপাসনা করা হয়। আর এটাই মূলতঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ (لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ) এর তাৎপর্য। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন সত্য উপাস্য নেই। আল্লাহ্‌ বলেন, “আর তোমাদের উপাস্য একমাত্র আল্লাহ্‌। সেই দয়াময় ও পরম দয়ালু ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই।”[সূরা বাকারা ২:১৬৩] আরো বলেন, “আল্লাহ্‌ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানবানগণও এ সাক্ষ্য প্রদান করে। তিনি (আল্লাহ্‌) ন্যায় ও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।[সূরা আলে ইমরান ৩:১৮] 
আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে আর যা কিছুর ইবাদত করা হয়, কিংবা আল্লাহ্‌র সাথে আর যারই উপাসনা করা হয়...তার উপাস্যত্ব নিঃসন্দেহে বাতিল। কারণ তিনি ছাড়া আর কারো উপাসনা পাওয়ার অধিকার নেই। আল্লাহ্‌ বলেন, “আল্লাহ্‌, তিনিই একমাত্র সত্য। তারা তার পরিবর্তে যাকে ডাকে, তা বাতিল। আর আল্লাহ্‌ সুউচ্চ, মহান।”[সূরা হজ্জ ২২:৬২] 
আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাউকে  إِلَهতথা উপাস্য বা দেবতা নাম দিলেই সে উপাসনা পাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে না। “লাত, মানাত, উজ্জা-র” প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ বলেন, “এগুলোতো কতক নামমাত্র, যা তোমরা এবং তো

Post a Comment

কেমন লেগেছে পোস্টি? কমেন্টে জানান
website এ ১০ হাজার ++ বই আপলোড করা আছে,
Download কোনো সমস্যা হলে দ্রুত আমাকে কমেন্ট জানান, or msashohayeb12@gmail.com
করুন

Previous Next

সার্চ করুন ইচ্ছেমতো

Search results

نموذج الاتصال