একটি বাক্যকে আপনি বিভিন্নভাবে ইন্টারপ্রেট বা ব্যাখ্যা করতে পারেন এবং কখনো উভয় ব্যাখ্যার সম্ভাবনারই অবকাশ থাকে। কিন্তু সেই ইন্টারপ্রিটেশনের উপর ভিত্তি করে এবং অন্যান্য সমান সম্ভাব্য ইন্টারপ্রেটেশনকে অগ্রাহ্য করে যদি আপনি সেই বাক্যের উপর একটি সিদ্ধান্ত দিয়ে বসেন, সেটা আপনার ভুল সিদ্ধান্ত। তবে যদি আপনি প্রমাণ করতে পারেন যে, অন্য ব্যাখ্যাটি করার কোন সুযোগ নেই, তাহলে আপনার দাবি মেনে নিতে আমার সমস্যা নেই।
কুরআন কিংবা হাদীসের যতগুলো কথাকে অবৈজ্ঞানিক বলা হয়, তার সবগুলোর ব্যাপারেই উপরের কথাগুলো প্রযোজ্য।
নাস্তিকরাও যেমন এই বিষয়ে (সূর্য ঘোরে নাকি পৃথিবী ঘোরে) মুসলিমদের খোঁচা দেয়, তেমনি এই বিষয়ে মুসলিমদের মান্যবর উলামাদের থেকেও কিছু বক্তব্য এসেছে যার ফলে কেউ কেউ হয়তো সন্দেহে পড়েছেন।
একটি ইন্টেরপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যা অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, কুরআনে আছে:
- পৃথিবী স্থির
- সূর্য গতিশীল
- সূর্য পৃথিবীর সাপেক্ষে ঘোরে
এই তিনটি দাবির জন্য পেশ করা তিনটি আয়াত দিচ্ছি।
* পৃথিবী স্থির!
সুরা গাফির (মুমিন) এর ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:
اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ قَرَارًا
“তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন স্থির।”
* সূর্য গতিশীল
সুরা ইয়াসীন, আয়াত ৩৮।
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا
“সূর্য তার গন্তব্যের দিকে গতিময় আছে”
* সূর্য পৃথিবীর সাপেক্ষ ঘোরে:
وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَت تَّزَاوَرُ عَن كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَت تَّقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ
"আপনি দেখবেন যে সূর্য উদয়কালে ডানদিক থেকে তাদের গুহার দিকে হেলে পড়ে এবং যখন অস্ত যায় তখন বামদিক থেকে তাদের পাশ কেটে যায়।" (সুরা কাহফ, আয়াত ১৭)
এখন এই তিন আয়াতকে একত্রিত করে যে কেউ ব্যাখ্যা হিসেবে বলতেই পারে - পৃথিবী স্থির এবং সূর্য পৃথিবীকে চক্কর দেয়!
কিন্তু এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। আয়াতগুলো অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ---
প্রথম আয়াত:
جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ قَرَارًا
এই আয়াতের অর্থ এভাবেও করা যায় - “পৃথিবীকে এমনভাবে বানিয়েছেন যেখানে তোমরা স্থির হতে পারো।”
অর্থাৎ ‘ক্বারার’ (قَرَارًا) শব্দটি দিয়ে পৃথিবী স্থির না বুঝিয়ে, মানুষের অবস্থা বোঝানো। আর এর পূর্ণ অবকাশ আরবী ব্যকরণে আছে। আর এভাবে অর্থ করাই উচিৎ। কারণ আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ বলেছেন: “এবং আকাশকে বানিয়েছেন ছাদ।”
পুরো আয়াতটি পড়ুন -
اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ ۚ ذَٰلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ ۖ فَتَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ - 40:64
"আল্লাহই হচ্ছেন তিনি, যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে স্থির হবার জায়গায় পরিণত করেছেন এবং আকাশকে করেছেন ছাদ। তোমাদের তিনি আকৃতি দিয়েছেন, আর তোমাদের আকৃতিকে সুন্দর করেছেন। তিনি তোমাদের পবিত্র বস্তু থেকে জীবনোপকরন দিয়েছেন। সুতরাং জগতকুলের প্রভু আল্লাহ কতই না বরকতময়!" [গাফির (মুমিন) ৪০ : ৬৪]
অর্থাৎ এই আয়াতে قَرَارًا শব্দটি দ্বারা পৃথিবী স্থির ব্যাখ্যা না করে, “তোমরা পৃথিবীতে স্থির আছ” ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাৎপর্য হচ্ছে তোমরা ঘরবাড়ি বানিয়ে জমিনে ঠাঁই গ্রহণ করে আছ। এক বাড়িতে ৬০-৭০ বছর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাটিয়ে দিচ্ছ। তোমাদের মাথার উপর আকাশ তোমাদের জন্য ছাদের কাজ দিচ্ছে।
ইমাম ইবন জারীর তাবারী(র.)ও তাঁর তাফসীরে এই ব্যাখ্যাই করেছেন। তিনি বলেন:
( الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأرْضَ ) التي أنتم على ظهرها سكان ( قَرَارًا ) تستقرون عليها
{তোমাদের জন্য পৃথিবী বানিয়েছেন} যার পৃষ্ঠে তোমরা বসবাস কর {ক্বারার হিসেবে} যার উপর তোমরা স্থির আছ।
এখানে এসে কেউ বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে এই আয়াতে আকাশকে ছাদ বলার চমৎকার সব হিকমাহও তুলে ধরতে পারে। যেমনঃ আমরা যেই নীল আকাশ দেখে থাকি, সেটা মূলত বায়ুমণ্ডল। এই বায়ুমণ্ডল আমাদের মহাজাগতিক রশ্মি থেকে রক্ষা করছে, ছোটখাট উল্কাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, অতিবেগুনী রশ্মি থেকে হেফাযত করছে, গ্রীনহাউজের কাজ দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
দেখুন একই আয়াতের বৈজ্ঞানিক (!) ও অবৈজ্ঞানিক (!) দুই ব্যাখ্যাই কীভাবে করা যায়!
এখন কোন বিজ্ঞান না জানা আলেম যদি এই আয়াতের ক্বারার শব্দ দিয়ে বলতে চান যে, "পৃথিবী স্থির", তাহলে এর অবকাশ তো আরবী ভাষায় আছে। তিনি বিজ্ঞান জানলে অন্য ব্যাখ্যাটা হয়তো নিতেন। কিন্তু পৃথিবী স্থির এমন মন্তব্য করার কারণে তাঁর নিন্দা তো করা যায় না। কারণ বিজ্ঞান না জানা কোন নিন্দনীয় বিষয় না। আর এই বিজ্ঞানের জ্ঞান তো নতুন নতুন সংযুক্ত হচ্ছে। আজকে আমরাও এমন অনেক কিছু জানি না, যা পরবর্তীরা জানবে। এখন আমাদের না জানার কারণে কোন ভুল কথা যদি বলি, তাহলে কি নিন্দিত হব?
* আচ্ছা। এবার সূর্য গতিশীল কি-না সেই আলাপে আসি।
আল্লাহ সুরা ইয়াসীনে বলেছেন -
“ওয়াশ শামসু তাজরী লি-মুসতাক্বাররিন লাহা” (সুরা ইয়াসীন, আয়াত ৩৮)
- ওয়াশ শামসু = সূর্য
- তাজরী = প্রবাহিত হয়, বহমান হয়, জারি হয়।
- লি-মুসতাক্বাররিন লাহা = তার মুস্তাক্বার্র এর উদ্দেশ্যে।
এখানে দুইটা কনফিউশন।
- 'মুস্তাক্বার্র' মানে কী?
- এই আয়াতে উল্লিখিত সূর্যের গতির ব্যাখ্যায় বর্ণিত সহীহ হাদীসের তাৎপর্য কী?
১। 'মুস্তাক্বার্র' অর্থ
মুস্তাক্বার্র এর লিটারেল বা আক্ষরিক অর্থ স্থির হবার জায়গা। মুসাফির তার সফরে তার গন্তব্যে পৌঁছে স্থির হয়। তাই গন্তব্যকে মুস্তাক্বার্র বলা হয়। ইরাকের শায়খ আলূসী রহিমাহুল্লাহ এটা উল্লেখ করেছেন।
শায়খ আলী তানতাবী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন: গ্রামার অনুযায়ী মুস্তাক্বার্র এর অর্থ সময়ও করা যায়। (কারণ এটা হচ্ছে যরফের সীগাহ। আর যরফ দিয়ে স্থান ও কাল দুইই বোঝায়) সুতরাং সূর্য ততদিন পর্যন্ত গতিশীল আছে, যতদিন সূর্য স্থির হয়ে না যাচ্ছে। অর্থাৎ কিয়ামতের আগ পর্যন্ত।
অর্থাৎ 'মুস্তাক্বার্র' এর অর্থ স্থির হবার জায়গা কিংবা স্থির হবার সময় দুটোই করা যায়। স্থির হবার সময় অর্থ ধরে নিলে তো কোন সন্দেহ-ইশকাল নেই। কিন্তু স্থির হবার জায়গা ধরলে কিছু প্রবলেমেটিক প্রশ্ন মনে উদয় হয়। যেমনঃ
- বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্য তো ক্রমাগত গতিশীল। সূর্য তো স্থির হয় না। তাহলে সূর্য তার স্থির হবার জায়গার উদ্দেশ্যে গতিশীল আছে, এই কথা বলার অর্থ কী?
এখানে এসেই ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একই শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যেমন থাকে, তেমনি এর লোকমুখে প্রচলিত বা 'উরফী' অর্থও থাকে। অন্য একটি আর্টিকেলে এটা আমরা দেখেছি - মাগরিব/মাশরিকের প্রচলিত অর্থ পূর্ব/পশ্চিম হলেও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল সূর্য উদয়/অস্তের স্থান।
একইভাবে 'মুস্তাক্বার্র' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ স্থির হবার জায়গা হলেও প্রচলিত অর্থ হচ্ছে মুসাফিরের গন্তব্য স্থল। সুতরাং এই প্রচলিত অর্থ যদি আয়াতের ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে বলা যায় - সূর্য তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভ্রাম্যমাণ আছে। আয়াত থেকে “সূর্য স্থির হয়” এই ব্যাখ্যাই নিতে হবে - এমন নয়।
কিন্তু এই আয়াত থেকে “তথাকথিত” অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও করা সম্ভব। অর্থাৎ গতি থামিয়ে সূর্য স্থির হয় এভাবেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেমন এই আয়াতের তাফসীরে বুখারীতে নিচের হাদীসটি আছে:
عن أبي ذر رضي الله عنه قال قال النبي صلى الله عليه وسلم لأبي ذر حين غربت الشمس أتدري أين تذهب قلت الله ورسوله أعلم قال فإنها تذهب حتى تسجد تحت العرش فتستأذن فيؤذن لها ويوشك أن تسجد فلا يقبل منها وتستأذن فلا يؤذن لها يقال لها ارجعي من حيث جئت فتطلع من مغربها فذلك قوله تعالى والشمس تجري لمستقر لها ذلك تقدير العزيز العليم
সাহাবী আবু যর গিফারী রাঃ বলেন, আমি মসজিদে নবী (ﷺ ) এর কাছে বসা ছিলাম, এমনসময় সূর্য ডুবে গেল। তিনি বললেন: হে আবু যর! সূর্য কোথায় যায় তুমি কি জান? আমি বললাম: আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন। তিনি বললেন: সূর্য তার আরশের নিচে গিয়ে সেজদা করে এবং তার কাছে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি চায়। অতঃপর তাকে অনুমতি দেয়া হয়। এমন সময় আসার উপক্রম হয়েছে যখন সে সেজদা করবে, কিন্তু কবুল করা হবে না। সে অনুমতি চাইবে, কিন্তু অনুমতি দেয়া হবে না। তাকে বলা হবে, যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও এবং অস্তের স্থান থেকে উদিত হয়। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার কথা والشمس تجري لمستقر لها ذلك تقدير العزيز العليم এর ব্যাখ্যা।
এই হাদীসকে কেউ যদি এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, প্রতিদিন সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, এরপর পশ্চিমে গিয়ে অস্ত যায়। এরপর নিজের গতি থামিয়ে আল্লাহর কাছে অনুমতি চায়। অনুমতি পেলে পুনরায় গতি কন্টিনিউ করে একই যাত্রার পুনরাবৃত্তি করে। তাহলে অবশ্যই এর অবকাশ আছে।
- এখন বিজ্ঞানবাদীরা যদি প্রশ্ন করে, সূর্য তার গতি থামিয়ে দেয়?! এ কেমন অবৈজ্ঞানিক কথা!?
তাকে বলা হবে: সূর্য তার গতি থামানো, আল্লাহর সামনে সেজদা করা, অনুমতি চাওয়া, অনুমতি পেয়ে পুনরায় গতি আরম্ভ করা - এগুলো পরপর ঘটতে ঘণ্টাখানেক বা মিনিটখানেক বা সেকেন্ডখানেক সময় লাগে এমন কি আমরা বলেছি? এমন কি হতে পারে না এই সবগুলো কাজ ন্যানোসেকেন্ডের ব্যবধানে (10^-9s) ঘটে যায় কিংবা পিকোসেকেন্ডে (10^-12 s) কিংবা ফেমটোসেকেন্ডে (10^-15 s)? আপনি কি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবেন ইনফিনিটেসিমালি ছোট সময়ের জন্যও সূর্য গতি থামায় না? অন্তত কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী এমন দাবির কোন সুযোগ নেই। কারণ আপনার পক্ষে কোন বস্তুর গতিই কন্টিনিউয়াসলি মাপা সম্ভব না। আপনার পর্যবেক্ষনের সময় অবশ্যই কোয়ান্টাইজড হবে? এবং আপনার পরপর দুইটি পর্যবেক্ষনের মাঝে অবশ্যই Δt ≥ ħ/2ΔE সময়ের ব্যবধান থাকবে (কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাইজেনবার্গের law of uncertainty principle অনুযায়ী)। সুতরাং বিজ্ঞান দিয়ে আপনি কোনদিনই এই ব্যাখ্যাকে ভুল বলতে পারবেন না।
এই হাদীস ক্লাসিকাল মেকানিক্স (মানে আমরা laymanরা যা দেখি বা বুঝি) দিয়েও ব্যাখ্যা সম্ভব।
কেউ যদি এভাবে ব্যাখ্যা করে - সূর্য পৃথিবীকে নিয়ে এমন অবস্থায় গতিশীল আছে যে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, আবার সূর্যও মহাকাশে তার নির্ধারিত কক্ষপথে গতিশীল আছে। ( যে কক্ষপথের কেন্দ্র হচ্ছে বিজ্ঞানমতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র ) মহাজাগতিক এই সুশৃংখল নিয়মের কারণে পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক গতি একইরকম থাকছে। সূর্য প্রতিনিয়তই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে যেন এই শৃংখলা বজায় থাকে। কিন্তু যখন কিয়ামত ঘনিয়ে আসবে, তখন এই শৃংখলায় ব্যাতিক্রম আসবে। পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক গতি নিয়ন্ত্রক গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্সে কোন পরিবর্তন আসবে। ফলে পৃথিবীর ঘুর্ণনে উলট-পালট হয়ে যাবে। ফলে সূর্যকে পশ্চিমে অস্ত যেতে দেখার পর আবার সেখান থেকে উদিত হতে দেখা যাবে।
আর আরশের নিচে সেজদা করার ব্যাপারে কথা হচ্ছে: মুসলিমদের বিশুদ্ধ আকীদা অনুযায়ী আরশ সকল সৃষ্টিজগতকে বেষ্টন করে আছে। যত যা কিছু আছে সবই আরশের নিচে। তাই আরশ নিয়ে জল ঘোলা করার কোন প্রয়োজন নেই।
কথা বলছিলাম, বিভিন্ন ব্যাখ্যা বা ইন্টারপ্রিটেশনের কথা। সালাফদের স্বীকৃত নীতিগুলোকে ঠিক রেখে বিভিন্ন ব্যাখ্যার সুযোগ আছে। তেমনি কেউ যদি কোন ব্যাখ্যা না করে চুপ থাকে, তার অবকাশও রয়েছে। উপরের ব্যাখ্যাগুলো আমি করলাম জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার ক্ষুদ্র যে জানাশোনা আছে, তার আলোকে। কারো যদি জ্যোতির্বিজ্ঞান জানা না থাকে এবং তিনি এমন ব্যাখ্যা না করে আক্ষরিকতার মাঝে সীমিত থাকতে চান, তাকে আপনি নিন্দা করবেন কীভাবে?
*** সূর্য ঘোরে না পৃথিবী? ***
প্রতিদিন সকালে সূর্যকে পূর্ব দিকে উঠতে দেখি, বেলা বাড়ার সাথে সাথে পূর্ব থেকে ডানে হেলে যেতে দেখি, মধ্যদুপুরে সুর্যকে ঠিক মাথার উপরে দেখি, এরপর সূর্যকে ঢলে পড়তে দেখি, সন্ধ্যার আগে সূর্যকে পশ্চিমে দেখি, এরপরই সেখানেই ডুবে যেতে দেখি।
আমি নিজে কি স্থির নাকি গতিশীল? আমি তো সারাদিন বাসায়ই শুয়ে বসে ছিলাম। তাহলে আমি যদি স্থির হই, আমার বাসা যদি স্থির হয়, তাহলে সূর্য অবশ্যই গতিশীল! কারণ আমি তো তাই দেখছি।
বিজ্ঞানের অতিরিক্ত ডোজ দিয়ে যাদের মস্তিষ্ক কুয়াশাময়। তারা বলবে, দেখছেন কী বলে? কতবড় কাঠমোল্লা!
আমি বলি - ভাই থামেন। কারা কাঠমোল্লা, আর কারা কাঠবিজ্ঞানী তারা বিহিত এখনই হবে।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ হচ্ছে - স্কেলার ও ভেক্টর রাশি। এরপর জড়তার কাঠামো। এরপরের নিউটনের গতির সুত্র। এরপর মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ। এরপর কেপলারের সুত্র। আপনারা প্রথম চ্যাপ্টার না পড়ে পঞ্চম চ্যাপ্টারে লাফ লাফ দিয়ে যান বলেই আপনাদের এই দশা। ভেক্টর কী, জড়তার কাঠামো কী - আপনাদের শেখা হয় না। কিন্তু কেপলারের সুত্র "পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে" নিয়ে আপনাদের বেশ লাফ-ঝাপ দেখা যায়।
আপনি যদি প্রথম ও দ্বিতীয় চ্যাপ্টার পড়তেন। তাহলে বেগ কাকে বলে ধারণা পেতেন। আপেক্ষিক বেগ কাকে বলে? পরম বেগ কাকে বলে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতেন। জড়তার কাঠামো বা ফ্রেম অফ রেফারেন্স কাকে বলে বুঝতেন। এই চ্যাপ্টারগুলো না পড়েই আপনারা কেপলারের সুত্রে লাফ দিয়েছেন বলেই আপনাদের মুখে বোকার হাসি লেগেই থাকে।
আসুন আপনাদের আমি আপেক্ষিক বেগ শেখাই।
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, আমার বন্ধু চলন্ত গাড়ি ড্রাইভ করছে। আমি বাসার সামনে দাঁড়ানো। বাসার সামনে রাস্তা ধরে সামনে এগুলো মেইন রোডে ওঠা যায়। বন্ধুকে আমি গাড়ি চালিয়ে মেইন রোডে উঠে যেতে দেখলাম।
প্রশ্ন: কে এগিয়ে গেল, আমি না আমার বন্ধু?
-আপনি উত্তর দিলেন: আমার বন্ধু। তাতে কি?
-আমি বলি - ইন্তলিক, ইন্তলিক। চলুন, চলুন।
-ধরুন, আমি আপনাকে নিয়ে এবার বন্ধুর গাড়িতে উঠেছি। আর বন্ধুকে আমার বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। এবার গাড়ি চালিয়ে বাসা থেকে সামনের মেইন রোডে আপনাকে নিয়ে উঠে গেলাম। আপনি সারাক্ষন জানালা দিয়ে পেছনে তাকিয়ে ছিলেন। আপনি কি বন্ধুকে পিছিয়ে যেতে দেখেন নি?
- হ্যাঁ দেখেছি। তাতে কি? গাড়িতে উঠলে সবারই এমন মনে হয়। আপনার বন্ধুকে পিছিয়ে যেতে দেখলেও সে পিছিয়ে যায় নি। জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে পেছায় নি, আমরাই বরং সামনে এগিয়ে গিয়েছি।
-ওকে, ওকে। আচ্ছা, আপনার তো গাড়ি আছে। এবার নাহয় বন্ধুকে নিয়ে আপনিও সেই গাড়িতে উঠুন। উঠেছেন? ঠিক আছে। এবার আমি এক গাড়িতে, আপনি আরেক গাড়িতে। চলুন, দুইজন একই জায়গা থেকে গাড়ি স্টার্ট করি। প্রথমে দুইজনের গাড়িই একই বেগে চালাই। হুম। গাড়ি চলছে। দুইজনই সমান বেগে আছি। আপনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে কী দেখছেন?
- দেখছি, আপনার গাড়ি যেন আমার গাড়ির সাথেই চলছে। আপনাকেও আমি স্থির দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আপনি আমার সামনে থেকে নড়ছেন না।
-আচ্ছা। এবার আমি বেগ বাড়িয়ে দিই।
- হ্যাঁ। এইবার আপনি সামনে এগিয়ে গিয়েছেন।
-আচ্ছা। আমি বেগ কমিয়ে দেই, আপনি বাড়িয়ে দিন।
- ওকে। দিলাম। হুম। এখন আপনাকে পিছিয়ে যেতে দেখছি।
-এবার বুঝলেন আপেক্ষিক গতি কী?
- না। বুঝি নাই।
-বোঝেন নাই! শুধু শুধু তাহলে এতগুলো কথা লিখে পোস্ট বড় করলাম কেন? আচ্ছা যাক। কেতাবি ভাষাতেই বলি -
যে কোন পর্যবেক্ষনের জন্য প্রথমে একটি ফ্রেম অফ রেফারেন্স ঠিক করতে হয়। অর্থাৎ একটি আপনি পরিমাপ করার জন্য আগে ঠিক করতে হয়, আপনি কার সাপেক্ষে মাপবেন। ধরুন, আপনি ফিতা দিয়ে আপনার উচ্চতা মাপবেন। প্রথমে ০ দাগ পায়ের আঙ্গুলের নিচে রেখে, এরপর বাকি ফিতা মাথা পর্যন্ত তোলেন। এই ০ দাগটিই হচ্ছে ফ্রেম অফ রেফারেন্স। ফ্রেম অফ রেফারেন্সকে জড়তার কাঠামোও বলে। আমাদের প্রত্যেকের চোখই আমাদের নিজস্ব ফ্রেম অফ রেফারেন্স। আমরা নিজেদের সাপেক্ষেই সব হিসাব-নিকাশ করি।
এ কারণে আমি যদি দাঁড়িয়ে থাকি, আর আপনি গাড়িতে চড়েন। তাহলে আমার সাপেক্ষে আপনি গতিশীল। আর আপনি যদি দাঁড়িয়ে থাকেন, আর আমি গাড়িতে চড়ি। তাহলে আমার সাপেক্ষে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আপনিই গতিশীল। আমি যে আপনাকে পিছিয়ে যেতে দেখছি। এটা নজরের ধোঁকা জাতীয় কিছু না। এটাই বাস্তবতা। একে বলে রিলেটিভ বা আপেক্ষিক বাস্তবতা। এটা আহামরি কিছু না। নাইন-টেন থেকে নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটের ফিজিক্স বইয়ের দ্বিতীয় চ্যাপ্টারেই এগুলো পেয়ে যাবেন।
সুতরাং আমি যে সূর্যকে ঘুরতে দেখি। আমার পর্যবেক্ষনে পৃথিবী স্থির থাকে আর সূর্য গতিশীল থাকে, এটা কোন নজরের ধোঁকা বা অবৈজ্ঞানিক কিছু না। পৃথিবী আমাকে নিয়ে সমান গতিতে গতিশীল। তাই আমার সাপেক্ষে পৃথিবী স্থির। আর পৃথিবীর সাথে সূর্যের আপেক্ষিক গতি আছে, তাই আমার সাপেক্ষেও আছে। একারণে আমার সাপেক্ষে সূর্যই গতিশীল, পৃথিবী না।
নাইন-টেন থেকে একটা লাইন পড়ে আসছি "সকল স্থিরতাই আপেক্ষিক স্থিরতা এবং সকল গতিই আপেক্ষিক গতি। কোন স্থিরতাই পরম নয়। পরম নয় কোন গতিই।" আপনি যদি বিজ্ঞান অর্ধের না কপচিয়ে পুরোটা কপচাতেন তাহলে এসব অ্যামেচারিশ কথাবার্তা বলতেন না।
সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে কথাতে ভুল কোথায়!? আমি পৃথিবীতে বসে সূর্য দেখি। পৃথিবী আমার ফ্রেম অফ রেফারেন্স। আমার রেফারেন্স ফ্রেম অনুযায়ী সূর্যই ঘোরে, পৃথিবী স্থির থাকে। এই কথার ভুল কই!!
যারা বলে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে। তারা এটা বলে সূর্যকে ফ্রেম অফ রেফারেন্স চিন্তা করে। অর্থাৎ কেউ যদি সূর্যতে বসা থাকে, তাহলে সে পৃথিবীকে এর চারিদিকে ঘুরতে দেখবে। আপনি মশায় যখন মুসলিম আলেমদের নিয়ে মশকরা করেন, তখন আপনার গদিটি কোথায় থাকে? সূর্যে? না চন্দ্রে? না ভূপৃষ্ঠে? (গদি মানে আসন)
আপনি পৃথিবীতে বসে সূর্যকে রেফারেন্স বানিয়ে পৃথিবীর হিসাব করেন। আর যারা পৃথিবীকে রেফারেন্স বানিয়ে সূর্যের গতি হিসাব করেন, তাদের ভুল ধরেন। আর বিজ্ঞান কপচিয়ে বেড়ান! বিজ্ঞান না আপনি জানেন! আর না তারা জানে!
হ্যাঁ। স্বীকার করি – মুসলিম আলেমদের অনেকেই বিজ্ঞান জানেন না। বিজ্ঞান জানলে তাঁরাও ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশনের অপশনটি গ্রহণ করতেন। যেই একাধিক ইন্টারপ্রিটেশনের সম্ভাবনার কথা আগে বলে এসেছি। তারা সুরা কাহফের এই আয়াত দেখে সিদ্ধান্তে এসেছেন, সূর্যই ঘোরে। পৃথিবী না।
আল্লাহ বলেনঃ
وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَت تَّزَاوَرُ عَن كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَت تَّقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ
"আপনি দেখবেন যে সূর্য উদয়কালে ডানদিক থেকে তাদের গুহার দিকে হেলে পড়ে এবং যখন অস্ত যায় তখন বামদিক থেকে তাদের পাশ কেটে যায়।" (সুরা কাহফ, আয়াত ১৭)
আল্লাহ আয়াতে স্পষ্ট বলেছেন, সূর্য ডানদিকে হেলে পড়ে। আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন, সূর্য বামে পাশ কেটে যায়। আল্লাহ সুরা ইয়াসীনে বলেছেন, والشمس تجري সূর্য জারি আছে, গতিময় আছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সূর্যকেই ফায়েল বা কর্তা বানানো হয়ছে। এই কাজগুলো সূর্যের সাথেই নিসবত করা হয়েছে। ডানে যায় সূর্যই, বামে যায় সূর্যই, গতিশীলও সূর্যই।
ফিজিক্সের রিলেটিভ মোশনের কনসেপ্টও এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ দর্শক হচ্ছে পৃথিবীবাসী মানুষ। আর আল্লাহ কুরআনে খিতাব বা সম্বোধনও করেছেন মানুষের বোধগম্য ভাষায়। মানুষের ফ্রেম অফ রেফারেন্স অনুযায়ী সূর্য গতিশীল - এতে কোন সন্দেহ-ইশকাল নেই।
তাদের অনুসরণে অনেক আলেম পরবর্তীতে দাবি করেছে, পৃথিবী ঘোরে এটা নাকি প্রোপাগান্ডা। এখানেই ভুলটা তাদের হয়েছে। তারা যদি ফিজিক্স জানতেন, তাহলে বুঝতেন যে। একইসাথে উভয় ব্যাখ্যার সহাবস্থানের অবকাশ রয়েছে।
নাস্তিকদের টপ টেন আনসায়েন্টিফিক ভার্সেস ইন কুরআন (কুরআনের শীর্ষ ১০ অবৈজ্ঞানিক আয়াত) নামক রাবিশ ভিডিওগুলোতে কিতাবে আযীয ও হাকীমের নিচের এই আয়াতও পাবেন -
সুরা কাহফে আল্লাহ যুল কারনাইনের ব্যাপারে বলেনঃ
حَتَّىٰ إِذَا بَلَغَ مَغْرِبَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَغْرُبُ فِي عَيْنٍ حَمِئَةٍ
"যখন সে সূর্যের অস্তচলে পৌঁছল তখন সে আবিষ্কার করল যে এটি একটি কাঁদাময় জলাধারে অস্তমিত হচ্ছে" (সুরা কাহফ, ৮৬)
ওয়াজাদা অর্থ খুঁজে পাওয়া, আবিষ্কার করা।
- এখানেও সেই আপেক্ষিকতা কথা। যুল কারনাইন পৃথিবী থেকে সূর্যকে দেখেছেন। তার ফ্রেম অফ রেফারেন্স তিনি নিজেই। তার সাপেক্ষে সূর্য গতিশীল। অস্ত যাবার সময় সূর্য সেই জলাধারের ওপাড়ে চলে গিয়েছে। সীবিচে গিয়েও আপনি একই জিনিস দেখতে পারবেন। পৃথিবী গোল হওয়ায় এমনটা হয়ে থাকে।
তাহলে সঠিক কে? আর ভুল কে? সূর্য কি সমুদ্রে অস্ত যায় নাকি যায় না?
উত্তর - দুইটাই ঠিক। কেউই ভুল না। এটাই হল আপেক্ষিকতা। আপনি যদি আপনার সাপেক্ষে হিসেব করেন, তাহলে আপনার সাপেক্ষে সমুদ্রের যতটুকু আপনি দেখেন তার ওপাড়ে সূর্য চলে গিয়েছে, যা খালি চোখে দেখতে সমুদ্রে সূর্যের ডোবার মত। আর যদি আপনি বৃহত্তর পরিসরে হিসেব করেন, ধরুন এমন উঁচু স্থান থেকে যে পুরো সমুদ্র দেখা যায়। তাহলে আপনি সূর্যকে সমুদ্রে ডুবতে দেখবেন না।
উপসংহার
কুরআনের একই আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা সম্ভব। মানুষ যেকোন ব্যাখ্যাই তার পূর্বে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে করে। যতই আপনি জগত সম্পর্কে জানতে থাকবেন, ততই আপনার পক্ষে কুরআনের আয়াতগুলো বিভিন্ন আঙ্গিকে ইন্টারপ্রেট করতে পারবেন। আর কন্ট্রাডিক্টিং ব্যাখ্যা থেকে সঠিকটি বেছে নিতে পারবেন।
শুধু বিজ্ঞান জানলেই হবে এমন না। বরং আরবী ভাষা ও তাফসীরের মূলনীতিগুলোতেও দক্ষ হতে হবে। নয়ত যেই প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি, সেগুলোর জবাব আপনি দিতে পারবেন না।