টানা মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কুফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ক্যাসিনো কাণ্ড থেকে শুরু করে পাপিয়া কাণ্ড, ত্রাণ আত্মসাৎ, দুঃস্থদের টাকা আত্মসাৎ বা মনোনয়ন বাণিজ্য; আওয়ামী লীগের ভালো কিছু যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। শুধুমাত্র খারাপ, খারাপ, খারাপ। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, আওয়ামী লীগের অনিয়ম, আওয়ামী লীগ কর্মীদের নানারকম অপকর্মের ফিরিস্তির তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন যে দলের মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কারণে দলের বদনাম হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের পঁচন ধরেছে বেশ ভালোমতোই। বিশেষ করে, তৃণমূলের আওয়ামী লীগ প্রায় নষ্টই হয়ে গেছে। যারা দুঃস্থদের আড়াই হাজার টাকা মেরে দেবার জন্য তৎপর হয়, তারা জনগনকে কী সেবা দিবে সেই প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগের এই অধঃপতন কিংবা বিপদগ্রস্ততা আজকে নয়।
১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদরাসা ময়দানের মাঠের জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে চাল নিয়ে আসি। গ্রামে গ্রামে পাঠাই আর চোরাকারবারিরা সেই চাল চুরি করে খায়। ইচ্ছে হয় ওদের পেটের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে আমি কালোবাজারির পয়সা বের করে আনি’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দলের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুদ্ধ্ব ছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে কথা বলতেন। শেখ হাসিনাও ক্ষুদ্ধ্ব। তবে তিনি প্রকাশ্যে কথা বলছেন না। প্রশ্ন হলো যে আওয়ামী লীগ কেন এতো পঁচে গেল? রাজনীতিবিদরা বলছেন এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ। এই কারণগুলো দেখে যাক-
১. দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে লোভ জেগেছে। বিলাসিতা করার প্রবণতা বেড়েছে। বাড়ি-গাড়ি করার এক মানসিকতা তৈরি হয়েছে। কারণ ক্ষমতায় থাকলে টেন্ডার পাওয়া যায়। ক্ষমতায় থাকলে নানারকম সুযোগ-সুবিধা হাসিল করা যায়। ক্ষমতায় থাকলে অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়া যায়- কেউ প্রশ্ন করে না। এজন্য দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের মধ্যেই নানারকম লোভ ঢুকে গেছে। এই লোভ থেকেই পঁচন ধরেছে কিছু নেতার মধ্যে।
২. টাকা কেন্দ্রিক রাজনীতি
আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন টাকা কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের এমপি বা স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও টাকার মালিক হতে হবে, টাকা থাকলে নেতৃত্ব পাওয়া যাবে, টাকা থাকলে এমপি হওয়া যাবে, উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া যাবে। আর টাকা না থাকলে কিছুই হওয়া যাবে না। এরকম একটি বোধ এবং ব্যাধি আওয়ামী লীগের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, যেটা আওয়ামী লীগের পঁচে যাবার পেছনে একটি বড় কারণ।
৩. আওয়ামী লীগে আদর্শহীনতা
আওয়ামী লীগে আদর্শের কোন চর্চা এখন হচ্ছে না বললেই চলে। রাজনৈতিক দল হিসেবে যে, কর্মীদের মাঝে আদর্শকে ছড়িয়ে দেয়া, চর্চা করা বা আদর্শের লালন করা সেগুলো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের মাঝে আর নেই। এক ধরণের আত্মপ্রসাদ এবং আত্মতুষ্টির মধ্যেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। যার ফলে আওয়ামী লীগ এখন আদর্শের চর্চা করে না। আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে এখন বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র স্লোগানে উচ্চারিত নাম, বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেয়া নাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ চর্চা করার মতো লোক বাস্তবে খুঁজে পাওয়া খুব বিরল ব্যাপার হবে।
৪. অনুপ্রবেশকারী
২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকছে এবং এরা সুযোগসন্ধানী, সুবিধাভোগী এবং এদের আওয়ামী লীগে ঢোকার মূল কারণ হলো ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা করা। আর এই অনুপ্রবেশকারীরাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও বিভিন্ন সময় এ সমস্ত অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের নেটওয়ার্ক এখন এত বিস্তৃত যে এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
৫. সিনিয়রদের উদাসীনতা
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও এখন উদাসীন। বরং তারা এখন ব্যস্ত নিজেদেরকে নিয়ে। নেতাকর্মীদের আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। বরং এই সমস্ত সিনিয়র নেতারাই বড় ধরনের টেন্ডার এবং নানারকম অবৈধ কর্মের সাথে জড়াচ্ছেন। ফলে কর্মীরা মনে করছেন যে এটা থেকে তারা কেন বঞ্চিত থাকবেন। কাজেই তারাও নানারকম দুর্নীতি, অপকর্মের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন।
এ সমস্ত কারণেই আওয়ামী লীগ এখন যেমন ক্যাসিনো কাণ্ডে জড়াচ্ছে, তেমনি দুঃস্থ-কর্মহীনদের জন্য বরাদ্দ আড়াই হাজার টাকার লোভও সামলাতে পারছে না।