আফগানিস্তানে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের আঘাতে গুড়িয়ে গেছে শত শত ঘরবাড়ি ছবি: এএফপি
আফগানদের দুঃখের গান শেষ হয় না। যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি শক্তির আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত এ মালভূমি। যেমন তার রুক্ষ পর্বত ও শুষ্ক আবহাওয়া, তেমন তার ভাগ্য। মরুভূমি যেমন মুহূর্তেই শুষে নেয় একপশলা বৃষ্টির ফোঁটা, তেমন আফগানদের জীবন থেকে কে যেন শুষে নিয়েছে যাবতীয় আনন্দ ও উচ্ছলতা। তাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, সংস্কৃতি বারবার তছনছ হয়ে যায়। হাতছাড়া হয়ে যায় প্রাকৃতিক সম্পদ। বারবার হানা দেয় হানাদার বাহিনী। দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে সেই হানাদার বাহিনীও দূর হয়। নতুন সরকার আসে, তবু মাথা তুলে দাঁড়ানো হয় না। ঘর গোছানোর আগে আরেক দুর্যোগ এসে সেটি ভেঙে দিয়ে যায়।
গত দুই দশকে কতবার যে ‘মানবিক বিপর্যয়’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে আফগানিস্তানকে নিয়ে, সেটির শেষ আর হয় না। বুধবার ভোরে ভয়াবহ ভূমিকম্প এসে সেই বিপর্যয় যেন আরও বাড়িয়ে দিল। পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় খোস্ত প্রদেশে সেই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষ মারা গেছে। ভূমিকম্পের কয়েক দিন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের নিচে বিপুল মানুষ চাপা পড়ে থাকার খবর আমরা পাই বিদেশি বার্তা সংস্থা থেকে। একে তো দরিদ্র পাহাড়ি এলাকা। বাড়িঘরগুলোও দুর্বল। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সয়ে টিকে থাকার মতো নয়। ফলে ভূমিকম্পের ধাক্কায় শত শত বাড়িঘর ধসে পড়েছে। অনেক গ্রাম একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে।"
এক ভূমিকম্প আরও ভূমিকম্পকে টেনে নিয়ে এসেছে, পরপর কয়েকবার ভূকম্পনে কাঁপে ওই এলাকা। ডেকে নিয়ে এসেছে আরও দুর্যোগ—টানা ভারী বৃষ্টি, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি, ভূমিধস ও বন্যা। মড়ার উপর একের পর এক খাঁড়ার ঘা। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষকে উদ্ধার করার পরিস্থিতিও সেখানে রইল না। কী এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয়েছে, তার কতটা প্রতিফলন আমরা দেখছি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে?
করোনা পরিস্থিতিতে টালমাটাল গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানের ঘটনা। সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের হাতে পরাজয় বরণ করে পরাশক্তি আমেরিকা ও তার মিত্রদের লজ্জাজনক প্রত্যাবর্তন ঘটল। ক্ষমতার পালাবদলে কাবুলের মসনদে বসল তালেবান। আফগানিস্তান কার কার বাণিজ্যের বাজার হতে যাচ্ছে, তার প্রাকৃতিক সম্পদের ফায়দা লুটতে যাচ্ছে কে—চীন নাকি রাশিয়া? তালেবান সরকারের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে তুরস্ক বা কাতার? আফগানিস্তান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসা ভারত কীভাবে আবার তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে? তালেবানের কাবুল দখলে
এমন সব বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুনিয়ার সব বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ ব্যস্ত ছিলেন কয়েক মাস। আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হলেও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাজসাজ যুদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী তুমুল উত্তেজনা, তর্কবিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল কী, আফগানিস্তানের পাশে কেউ নেই, কাবুলের নতুন সরকার তালেবানকে কেউ স্বীকৃতি দেয় না। আফগানিস্তানে বিশ্ববাজারের পা পড়ে না। অর্থনীতিও চাঙা হয় না। তালেবানের বিজয়ের অংশীদার পাকিস্তানও এক পা এগিয়ে আসে তো আরেক পা পিছিয়ে যায়।
টানা দুই দশক ধরে যুদ্ধ করে ক্ষমতায় আসা দলটিও কঠোর কঠোর নিয়মে নাগরিকদের জন্য জীবনকে করে তোলে আরও বেশি কঠিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের চেয়েও, প্রায় দুর্ভিক্ষে ভুগতে থাকা মানুষের পেটে খাবার দেওয়ার চেয়েও তালেবান সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মেয়েরা স্কুলে পড়বে কি পড়বে না, বোরকার সীমারেখা কতটুকু হবে, পুরুষেরা চুল-দাড়ি কেমন রাখতে পারবে, উপস্থাপিকারা কীভাবে টিভি পর্দায় হাজির হবেন এসব বিষয়। সেসবের কারণে পশ্চিমা গোষ্ঠীও দেশ পুনর্গঠনে নানা শর্তের বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলে তালেবান সরকারকে। অনেক সাহায্য ও সহায়তাকারী সংস্থাও তো তালেবান ক্ষমতায় আসার পরপরই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। অবশেষে জাতিসংঘের মাধ্যমে আমরা দেখছি কী, খাদ্যসংকটে আফগানিস্তানে ৯৩ শতাংশ মানুষ। দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এতটাই ভয়াবহ যে তারা টেবিলে খাবার সরবরাহ করতেও পারছে না।
এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে আঘাত হানল গত দুই দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। পাকতিকা ও খোস্ত প্রদেশে আঘাত হানা ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ১। খোস্তের রাজধানী শহর থেকে আনুমানিক ৪৪ কিলোমিটার দূরে ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। পাকিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা হওয়ায় সেই ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের কিছু এলাকাও। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এখনো অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দাঁড়ায়নি, ধসে যাওয়া যোগাযোগব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি, চিকিৎসাব্যবস্থার বেহাল। ভূমিকম্পে হাসপাতালগুলো পর্যন্ত ধসে গেছে। তালেবান সরকারের একজন মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা ভূমিকম্প উপদ্রুত এলাকাগুলোতে যেতে পারছি না। যোগাযোগব্যবস্থা খুবই দুর্বল।’ প্রতিকূল আবহাওয়া সেটিকে আরও বেশি অসম্ভব করে তুলেছে। পাকতিকা প্রদেশের ছোট শহর জিয়ানের পাঁচ শয্যার একটি ক্লিনিক। সেটির সব কক্ষও ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ সেখানে বুধবার সকালেই পাঁচ শ রোগীর চাপ পড়ে গেল, তাদের মধ্যে দুই শ মারাও গেল। কেউ হারিয়েছেন পরিবারের নয় সদস্য, কেউ হারিয়েছেন ১৯ সদস্য। খাবার, পানি, ওষুধের হাহাকার চারিদিকে। যার ক্ষোভে তালেবানের এক গর্ভনরকেও তাড়িয়ে দিয়েছে মানুষ।
ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার পেছনে যোগাযোগব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, দুর্যোগ প্রতিরোধব্যবস্থার দুর্বলতার কথা বারবার উঠে আসছে। এই কি ছিল ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর, তাদের সহায়তা সংস্থাগুলোর, সেই সঙ্গে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকারের ‘আফগানিস্তান পুনর্গঠন’?
বিবিসি জানায়, আহত রোগীদের বেশির ভাগই পুরুষ। কারণ, বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাঁরা কোনোরকমে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু নারী ও শিশুদের জন্য সেটি ছিল কঠিন। পাশের প্রদেশ, শহরগুলো ও কাছের এলাকাগুলো থেকে দৌড়ে আসা মানুষই উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। কাছের উরগান শহর থেকে আসা একজন স্বেচ্ছাসেবী একাই ৪০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন, যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল শিশু। আফগান শিশুদের পরিণতিই মনে হয় এমন! মার্কিন ড্রোন হামলায় মৃত্যুর দিন ফুরালে তাদের নতুন এক শৈশবে মেতে ওঠার কথা। সেটিও কেড়ে নিল ভূমিকম্প এসে। এক আহত শিশু হাসপাতালে এসে খুঁজছিল তার মা-বাবা, ভাই-বোনকে। পরক্ষণেই যখন জানল কেউ বেঁচে নেই, সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে তালেবান সরকারের মুখপাত্র বিলাল কারিমি জানান, অনেক দেশ ইতিমধ্যে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য পাঠিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বলেছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আফগানদের জন্য সাহায্য করতে জাতিসংঘ পুরোপুরি সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। আবার বিবিসিকে তালেবান সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবদুল কাহার বালখি বলেন, সহায়তা যথেষ্ট নয়। পরিমাণ আরও বাড়ানো দরকার। আবার অল্প যা সহায়তা পাওয়া গেছে, সেগুলোও দুর্গত এলাকায় পৌঁছানোও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টি শুধু খাদ্য, ওষুধপথ্য ও সাহায্য পাঠিয়েই পাশে দাঁড়ানোর জায়গায় নেই। কারণ, সেসব সহায়তা দিয়েও এ বিপর্যয় মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা তালেবান সরকারের নেই। নিহত মানুষকে দাফন করার মতো সরঞ্জামও পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে। চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই। মোবাইল টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পরিষ্কার পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সেখান থেকে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন চিকিৎসকেরা। ফলে বিদেশি উদ্ধারকারী টিম ও চিকিৎসক দল পাঠানো আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই কাজটি কেউ করছে না বলতে গেলে। সেই হতাশাই যেন এক স্বেচ্ছাসেবীর কণ্ঠে প্রকাশ পেল। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানকে বিশ্ব ভুলে গেছে।’ আরও দুঃখজনক হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জোট সার্কের সদস্য আফগানিস্তান, সেই সার্কও এখন মৃতপ্রায়। প্রতিবেশীর এমন ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলায় সার্কের সদস্যদেশগুলোর তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো নয়।
এ দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার পেছনে যোগাযোগব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, দুর্যোগ প্রতিরোধব্যবস্থার দুর্বলতার কথা বারবার উঠে আসছে। এই কি ছিল ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর, তাদের সহায়তা সংস্থাগুলোর, সেই সঙ্গে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকারের ‘আফগানিস্তান পুনর্গঠন’? সেই কাজে খরচ করা লাখ লাখ কোটি ডলারের দুর্নীতির কথা তো জানা কথাই। শুধু তাই নয়, গত দুই দশকে ৩০ হাজার আফগানের লাশ এবং ১ কোটি ১০ লাখ শরণার্থী ‘উপহার’ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও জব্দ করে রেখেছে। যার পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলার। বাইডেন সরকার ঘোষণা দিয়েছে, টুইন টাওয়ার হামলায় ভুক্তভোগীদের পেছনে এর অর্ধেক টাকা খরচ করা হবে। চীনা সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস সেটিকে বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ হয়ে নির্লজ্জভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশের সম্পদ লুট। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আফগানদের প্রতি মার্কিন সরকারের সমবেদনা প্রকাশ এবং পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণাকে অনেকটা ‘কুমিরের কান্না’ বলেই মন্তব্য করেছে চীনা পত্রিকাটি।
এ ভয়াবহ দুর্যোগের পর মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য আফগানদের রিজার্ভের টাকা কি ফেরত দেবে না যুক্তরাষ্ট্র? একইভাবে আমরা এ কারণেও অবাক হই, নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েও চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তানের মতো বন্ধুপ্রতিম দেশও তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিল না। যার ফলে দুঃখ বাড়ছে মূলত সাধারণ আফগানদেরই। মানবসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক আর কত বিপর্যয় সইবার পর শান্তির দেখা পাবে তারা? কবে তাদের দুঃখের গানের অবসান ঘটবে?