রাজশাহী, বলা হয় শান্তির শহর। শান্ত, চুপচাপ, নিরিবিলি।
কেউ যখন হোমটাউন জানতে চাইলে বলি রাজশাহী তখন অন্যদের মুখে শুনি রাজশাহী নিয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি ।
কিন্তু রাজশাহীর মানুষকে খাটো করে দেখে এমন কিছু মানুষকেও খুঁজে পেয়েছি। তেমনই এক ছেলের কাহিনী !বাসে করে রাজশাহী আসছিলাম, উদ্দেশ্য রাজশাহী। তো সেদিনের পরের দিন ছিলো রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। স্বাভাবিকভাবেই সিটের আশপাশে পেলাম বিভিন্ন জেলার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের। তেমনই এক ছেলে তার বন্ধুর সাথে গল্প করছে বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তে। প্রসঙ্গ রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ও রাজশাহী এলাকা। তার বর্ননা শুনে আমি বড়সড় শক্ খাইসিলাম! তার কথা হচ্ছে বাবার চাপে ছেলেটি ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসছে, কিন্তু রাজশাহীর মত গ্রামে থেকে পড়া তার জন্য পসিবল না, এখানকার মানুষের সাথে থাকলে সে নাকি বাংলা বলতে ভুলে যাবে! পাশের বন্ধুটি অবশ্য রাজশাহী সম্পর্কে কিছুটা জানে যা বুঝলাম। সে তাচ্ছিল্য করে যেটা বললো সেটা হলো পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হলেও সে এখানে পড়বেনা, এখানে শীতে সার্ভাইভ করা তার জন্য কঠিন, আর সবচেয়ে বড় কথা সে তার সো কলড্ ঢাকা ছাড়তে রাজি নয় কারন ঢাকার কিছু জীববস্তুউ নাকি অনেক হট্! ( সঙ্গত কারনে হট্ কারা, বুঝবে সবাই)। ধরা যাক ছেলেটার নাম "ছোটভাই "। তাকে উদ্দেশ্য করেই কিছু বলবো এখন।
একটি দেশের অভ্যন্তরে ভাষার উচ্চারনে তারতম্য থাকবেই, এটা আমাদেরকে খ্যাত করেনা। বরং আমাদেরকে ইউনিক বানায়।
চট্টগ্রামের ভাষা শুনেছ ছোটভাই? সে ভাষা বুঝতে বুঝতে তোমার দিন পার হয়ে যাবে কিন্তু চট্টগ্রামের সেই সুন্দর ভাষাটা দিয়েই বুঝে যাবে সে অন্ঞ্চলের মানুষদেরকে। ভাষা আমাদের একই, শুধু আলাদা সৌন্দর্য্যটাই নির্ধারিত হয় এলাকা নির্বিশেষে। সুতরাং রাজশাহীর সহজ সরল ভাষা তোমার কাছে খ্যাত, কিন্তু " রাজশাহীর ভাষা কিন্তু আমাদের কাছে মেলা আদরের, বুঝেছেন, কথা বুলার আগে বুঝে বুইলবেন তাহলে খো তোমরা এলাকা খাতির যত্ন পাবা "
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি মনে হয় আগে দেখোনাই ছোটভাই। একদিনে ঘুরে দেখে শেষ করতে পারবানা। এখানে বিনোদপুর থেকে কাজলা কাটাখালি পর্যন্ত মানুষের একতা দেখলে ঈর্ষান্বিত হতেই হবে। ভর্তি পরীক্ষা শেষে পারলে দুইদিন ভার্সিটিটা ঘুরে দেখো।
পহেলা বৈশাখে টিএসসির মত মেয়েদেরকে কোন বিপদে পড়তে হয়না এ ক্যাম্পাসে। যদি কেউ বিপদে পড়েও, তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার মত মানুষের সংখ্যা মোটেই কম নয়। পড়াশোনার পরিবেশ দেখতে হইলে ভার্সিটি চলাকালীন সময় এসে দেখো। কেউ শহীদ মিনারের পাশে, কেউ ইবলিস চত্বর, কেউ লাইব্রেরি, কেউ প্যারিস রোডের পাশে গ্রুপ বা সিঙ্গেল স্টাডি তে ব্যাস্ত। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও এখানে অসামাজিকতা দেখতে পাবেন না। কারন একটাই, রাজশাহীর মানুষ এখনো পরিবারমুখী, দিনের শেষে যাই হোক, সবাই সবার পরিবারকে সময় দেয়। সামাজিকীকরণ শিখতে আর কি লাগে!
শোন ছোটভাই, বুড়িগঙ্গার দূষিত নদীর মত পদ্মা না। কখনও সূর্যাস্ত দেখতে হলে পদ্মার ধারে গিয়ে দেখে আসতে পারো।
টি বাধ, আই বাধ, সীমান্তে নোঙর, লালনশাহ পার্ক, সিমলা পার্ক, পদ্মা গার্ডেন এ সব যেন পদ্মার ধারের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য্যৈর নাম। আর বিনোদনের জন্য যদি পার্কের খোঁজ চাও তবে কামরুজ্জামান পার্ক আর শহীদ জিয়া পার্ক এনাফ। তুমি হয়তো বলতে পারো মাত্র দুটি পার্ক কেন এই গ্রামে। কারন, এই সুন্দর ছোট্ট শহরের মানুষেরা অল্পেই সন্তুষ্ট। আমরা ইয়াংকিং, স্বপ্নীল, সৈকত, জমজম, সাফা ওয়াং, উত্তরা নামক কমিউনিটি সেন্টারগুলোতেই বিয়ে খেয়ে অভ্যস্ত, আমাদের শেরাটন বা সোনারগাও বসুন্ধরা লেবেলের কিছু নাই, তারপরও আমরা সবগুলো অনুষ্ঠানগুলোই পাই মিলন মেলা হিসেবে যেখানে অপরিচিত কোন মানুষের বিয়েতে যেয়েও পরিচিত সার্কেলের দেখা পেয়ে যাই অনায়াসে।
মহিষবাথান বলেন বা কোর্ট, রাজপাড়া বলেন বা বহরমপুর, ভাটাপাড়া বলেন বা হড়গ্রাম, রেলগেট বলেন বা শিরোইল, শালবাগান বলেন বা পাঠানপাড়া, কাঠালবাড়িয়া বলেন বা তালাইমারি, কাজিহাটা বলেন বা লক্ষিপুর মোড়, বন্ধু আমাদের সবখানেই। হাজারো ফ্ল্যাটের আড়ালে কখনই ঢাকা পড়েনা আমাদের বন্ধুত্ব। ভয় থাকেনা কোন দুর্ঘটনার। সবচেয়ে বড় কথা, রাজশাহীর মানুষের মত দিল খোলা মানুষ পাবানা কোথাও। জ্যামে আটকানোর ভয় থাকেনা ঘন্টার পর ঘন্টা। সবচেয়ে বড় কথা ঢাকায় যেখানে দুইটাকা বেশি চাওয়া নিয়ে বাসযাত্রী আর হেল্পারের মারামারি লাগে, সেখানে আমরা উল্টো অটোওয়ালা বা রিক্সাওয়ালাকে পাঁচ দশটাকা বেশি নিজে থেকেই দিই।
আমরা গ্রীষ্মে হয়তো রোদে পুড়ি, শীতে হয়তো আমাদের ফ্রীজই জমে যায় আপনা আপনি, কিন্তু এই প্রতিকূলতাই আমাদের কে শিক্ষা দেয় সহ্যশক্তি বাড়ানোর। এই দুটি ঋতু সহ বর্ষা শরৎ হেমন্ত আর বসন্ত আমরা প্রান ভরে উপভোগ করি। শরতের আকাশে
প্রত্যেক এলাকার ঘুড়ি গুলো জড়ো হয় একটা আকাশেই! ঘুড়ি কাটাকাটি নিয়ে হয়তো এলাকা এলাকা ঝগড়া মাঝেমাঝে হয়, কিন্তু এর মীমাংসা প্রক্রিয়াগুলো যথেষ্ট মজার।
ফাঁকা মাঠে বসে আকাশ দেখতে চাও ছোটভাই?