সবরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
মূল: শাইখ ড. সালিহ ফাউযান আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ) | অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
সবর বা ধৈর্য ধারণ করা আকীদার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জীবনে বিপদ-মুসিবত নেমে আসলে অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না। বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর নিকট প্রতিদান পাওয়ার আশা করতে হবে। ইমাম আহমদ রহঃ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নব্বই স্থানে সবর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।”
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: “সবর হল জ্যোতি।” (মুসনাদ আহমদ ও মুসলিম)
উমর রা. বলেন: “সবরকে আমরা আমাদের জীবন-জীবিকার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি।” (বুখারী)
আলী রা. বলেন: “ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হল দেহের মধ্যে মাথার মত।” এরপর আওয়াজ উঁচু করে বললেন, “যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই।”
উমর রা. বলেন: “সবরকে আমরা আমাদের জীবন-জীবিকার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি।” (বুখারী)
আলী রা. বলেন: “ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হল দেহের মধ্যে মাথার মত।” এরপর আওয়াজ উঁচু করে বললেন, “যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই।”
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকে দেন নি।” [সুনান আবু দাঊদ, অনুচ্ছেদ: নিষ্কলুষ থাকা। সহীহ]
সবরের প্রকারভেদ: সবর তিন প্রকার:
১) আল্লাহর আদেশের উপর সবর করা।
২) আল্লাহর নিষেধের উপর সবর করা।
৩) বিপদাপদে সবর করা।
২) আল্লাহর নিষেধের উপর সবর করা।
৩) বিপদাপদে সবর করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন বিপদ আসে না। আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তাঁর অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন।” [সূরা তাগাবুনঃ ১১]
আলকামা বলেন, “আল্লাহ তায়ালা ‘যার অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন’ সে হল ঐ ব্যক্তি যে বিপদে পড়লে বিশ্বাস করে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে বিপদে পড়েও সে খুশি থাকে এবং সহজভাবে তাকে গ্রহণ করে।”
অন্য মুফাসসিরগণ উক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, “যে ব্যক্তি বিপদে পড়লে বিশ্বাস রাখে যে এটা আল্লাহর ফায়সালা মোতাবেক এসেছে। ফলে সে সবর করার পাশাপাশি পরকালে এর প্রতিদান পাওয়ার আশা রাখে এবং আল্লাহর ফয়সালার নিকট আত্মসমর্পণ করে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, আর দুনিয়ার যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তার বিনিময়ে তিনি তার অন্তরে হেদায়াত এবং সত্যিকার মজবুত একীন দান করেন। যা নিয়েছেন তার বিনিময় দান করবেন।”
সাঈদ বিন জুবাইর রা. বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে হেদায়াত দেন।” এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ সে কোন ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপদের সম্মুখীন হলে বলে ‘ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন’ অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্যই আর তাঁর নিকটই ফিরে যাব।” [সূরা বাকারাঃ ১৫৬]
উক্ত আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। আরও প্রমাণিত হয় যে, ধৈর্য ধরলে অন্তরের হেদায়াত অর্জিত হয়।
জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধৈর্যের প্রয়োজন:
প্রতিটি পদক্ষেপে মুমিনের ধৈর্যের প্রয়োজন। আল্লাহর নির্দেশের সামনে ধৈর্যের প্রয়োজন। আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধৈর্যের প্রয়োজন। কারণ, এ পথে নামলে নানা ধরণের কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমার প্রভুর পথে আহবান কর হেকমত এবং ভাল কথার মাধ্যমে। আর সর্বোত্তম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। তোমার প্রভু তো সব চেয়ে বেশি জানেন, কে তাঁর পথ থেকে বিপথে গেছে আর তিনিই সব চেয়ে বেশি জানেন কারা সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।…আর ধৈর্য ধর। ধৈর্য ধর কেবল আল্লাহর উপর।” [সূরা নাহল: ১২৫-১২৭]
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে গেলেও চরম ধৈর্যের পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। কারণ, এ পথে মানুষের পক্ষ থেকে নান ধরণের যাতনার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা লোকমান সম্পর্কে বলেন, (তিনি তার সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন): “হে বৎস, নামায প্রতিষ্ঠা কর, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ কর। আর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধারণ কর। বিপদে ধৈর্য ধরণ করা তো বিশাল সংকল্পের ব্যাপার।” [সূরা লোকমান: ১৭]
মুমিনের ধৈর্যের প্রয়োজন জীবনের নানান বিপদ-মুসিবত, কষ্ট ও জটিলতার সামনে। সে বিশ্বাস করে যত সংকটই আসুক না কেন সব আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে সে তা হালকা ভাবে মেনে নেয়। বিপদে পড়েও খুশি থাকে। এ ক্ষেত্রে ক্ষোভ, হতাশা ও অস্থিরতা প্রকাশ করে না। নিজের ভাষা ও আচরণকে সংযত রাখে। কারণ, সে আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী। সে তকদীরকে বিশ্বাস করে। তকদীরকে বিশ্বাস করা ঈমানের ছয়টি রোকনের একটি।
তাকীরের উপর ঈমান রাখলে তার অনেক সুফল পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি হল, বিপদে ধৈর্য ধারণ। সুতরাং কোন ব্যক্তি বিপদে সবর না করলে তার অর্থ হল, তার কাছে ঈমানের এই গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিটি অনুপস্থিত। অথবা থাকলেও তা খুব নড়বড়ে। ফলে সে বিপদ মূহুর্তে রাগে-ক্ষোভে ধৈর্যহীন হয়ে পড়ে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর দিয়েছেন যে, এটা এমন এক কুফুরী মূলক কাজ যা আকীদার মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে।
বিপদ-আপদের মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মোচন হয়:
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন বালা-মুসিবত দেন এক মহান উদ্দেশ্যে। তা হল এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার গুনাহ মোচন করে থাকেন। যেমন আনাস রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি দেন। কিন্তু বান্দার অকল্যাণ চাইলে তিনি তার গুনাহের শাস্তি থেকে বিরত রেখে কিয়ামতের দিন তার যথার্থ প্রাপ্য দেন।“
ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন: “বিপদ-মুসিবত হল নেয়ামত। কারণ এতে গুনাহ মাফ হয়। বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে তার প্রতিদান পাওয়া যায়। বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে আরও বেশি রোনাজারি করতে হয়। তার নিকট আরও বেশি ধর্না দিতে হয়। আল্লাহর নিকট নিজের অভাব ও অসাহয়ত্তের কথা তুলে ধরার প্রয়োজন হয়। সৃষ্টি জীব থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হয়।…বিপদের মধ্যে এ রকম অনেক বড় বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে।“
বিপদে পড়লে যদি গুনাহ মোচন হয়, পাপরাশী ঝরে যায় তবে এটা তো বিশাল এক নেয়ামত। সাধারণভাবে বালা-মসিবত আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত লাভের মাধ্যম। তবে কোন ব্যক্তি যদি এ বিপদের কারণে এর থেকে আগের থেকে আরও বড় গুনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ে তবে তা দ্বীনের ক্ষেত্রে তার জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, কিছু মানুষ আছে যারা দারিদ্রতায় পড়লে বা অসুস্থ হলে তাদের মধ্যে মুনাফেকি, ধৈর্য হীনতা, মনোরোগ, স্পষ্ট কুফুরী ইত্যাদি নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেকে কিছু ফরয কাজ ছেড়ে দেয়। অনেকে বিভিন্ন হারাম কাজে লিপ্ত হয়। ফলে দ্বীনের ক্ষেত্রে তার বড় ক্ষতি হয়ে যায়। সুতরাং এ রকম ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিপদ না হওয়াই কল্যাণকর। মুসীবতের কারণে নয় বরং মুসীবতে পড়ে তার মধ্যে যে সমস্যা সৃষ্টি তার কারণে বিপদ না আসাই তার জন্য কল্যাণকর।
পক্ষান্তরে বিপদ-মুসীবত যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে ধৈর্য ও আনুগত্য সৃষ্টি করে তবে এই মুসীবত তার জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে বিশাল নেয়ামতে পরিণত হয়….।”
বিপদ-আপদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বান্দার ধৈর্যের পরীক্ষা নেন:
বিপদ দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করেন কে ধৈর্যের পরিচয় দেয় এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে পক্ষান্তরে কে ধৈর্য হীনতার পরিচয় দেয় ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “বিপদ যত কঠিন হয় পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ কোন জাতিকে ভালবাসলে তাদেরকে পরীক্ষা করেন। সুতরাং যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান আর যে তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।”
অত্র হাদীসে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। যেমন:
১) বান্দা যেমন আমল করবে তেমনই প্রতিদান পাবে। “যেমন কর্ম তেমন ফল।”
২) এখানে আল্লাহর একটি গুনের পরিচয় পাওয়া যায়। তা হল ‘সন্তুষ্ট হওয়া’। আল্লাহ তায়ালার অন্যান্য গুনের মতই এটি একটি গুন। অন্য সব গুনের মতই এটিও আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য হবে যেমনটি তার জন্য উপযুক্ত হয়।
৩) অত্র হাদীসে জানা গেল যে, আল্লাহ তায়ালা এক বিশাল উদ্দেশ্যে বান্দা উপর বিপদ-মসিবত দিয়ে থাকেন। তা হল তিনি এর মাধ্যমে তার প্রিয়পাত্রদেরকে পরীক্ষা করেন।
৪) এখানে তকদীরের প্রমাণ পাওয়া যায়।
৫) মানব জীবনে যত বিপদাপদই আসুক না কেন সব আসে আল্লাহর তকদীর তথা পূর্ব নির্ধারিত ফয়সালা অনুযায়ী।
৬) এখান থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, বিপদ নেমে আসলে ধৈর্যের সাথে তা মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি মূহুর্তে প্রতিটি বিপদের মুখে আল্লাহর নিকটই ধর্না দিতে হবে এবং তার উপরই ভরসা রেখে পথ চলতে হবে।
২) এখানে আল্লাহর একটি গুনের পরিচয় পাওয়া যায়। তা হল ‘সন্তুষ্ট হওয়া’। আল্লাহ তায়ালার অন্যান্য গুনের মতই এটি একটি গুন। অন্য সব গুনের মতই এটিও আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য হবে যেমনটি তার জন্য উপযুক্ত হয়।
৩) অত্র হাদীসে জানা গেল যে, আল্লাহ তায়ালা এক বিশাল উদ্দেশ্যে বান্দা উপর বিপদ-মসিবত দিয়ে থাকেন। তা হল তিনি এর মাধ্যমে তার প্রিয়পাত্রদেরকে পরীক্ষা করেন।
৪) এখানে তকদীরের প্রমাণ পাওয়া যায়।
৫) মানব জীবনে যত বিপদাপদই আসুক না কেন সব আসে আল্লাহর তকদীর তথা পূর্ব নির্ধারিত ফয়সালা অনুযায়ী।
৬) এখান থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, বিপদ নেমে আসলে ধৈর্যের সাথে তা মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি মূহুর্তে প্রতিটি বিপদের মুখে আল্লাহর নিকটই ধর্না দিতে হবে এবং তার উপরই ভরসা রেখে পথ চলতে হবে।
ধৈর্যের পরিণতি প্রশংসনীয়:
জীবনের সকল কষ্ট ও বিপদাপদে আল্লাহ তায়ালা নামায ও সবরের মাধ্যমে তাঁর নিকট সাহায্য চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, এতেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ধৈর্যের পরিণতি প্রশংসনীয়। আল্লাহ তায়ালা খবর দিয়েছেন যে, তিনি ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন। অর্থাৎ তাদেরকে তিনি তাদের সাহায্য করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামায ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য অনুসন্ধান কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন।” [সূরা বাকরা: ১৫৩]
এখান থেকে ধৈর্য ধারণ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। মুমিন ব্যক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি পদে পদে ধৈর্যের পরিচয় দেয়া দরকার। এই সবরের মাধ্যমে আকীদা ও বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করুন।