গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এই ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ হতাশা, গ্লানি, ক্ষোভে আত্মহত্যা করছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। কৈশোরে-তারুণ্যে আত্মহত্যার একটি অন্যতম কারণ পরীক্ষায় ফেল করা। জীবন কখনোই কারও জন্য কেবলই কমেডি ছিল বা থাকবে তেমনটি নয়, মাঝেমধ্যে ট্র্যাজেডিও নেমে আসে।
জীবন হচ্ছে সফলতা-ব্যর্থতার পালাবদলের এক অবিরাম ধারা। কোনো একটি কাজে ব্যর্থ হওয়া মানে শেষ হয়ে যাওয়া নয়। এ জন্য আত্মহত্যা করাটা বোকামি। পরীক্ষায় ব্যর্থতা বা যেকোনো ব্যর্থতার পর কেউ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, কেউ তীব্র নেতিবাচক আবেগে বিস্ফোরিত হয় (এরাই আত্মহত্যার চেষ্টা নেয়), আবার কেউ সাময়িক আপসেট থাকে মাত্র। কে কোন ধরনের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা অনেক দেহ-মনো-সামাজিক কারণের ওপর নির্ভর করে।
যারা পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মনে রাখা ভালো, পৃথিবীর অনেক সফল, বিখ্যাত ব্যক্তি পড়াশোনায় তেমন ভালো করতে পারেননি। তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন, স্টিভ জবস, বিল গেটস, এমনকি আইনস্টাইন।
যারা ফেল করেছে তাদের করণীয়:
১. অতিরিক্ত আতঙ্কিত হবে না—এটিই জীবনের শেষ নয় এবং তুমি একা ব্যর্থ হওনি। আরও অনেক পথ খোলা রয়েছে।
২. ব্যর্থ হলে হতাশ হওয়া, বিপর্যস্ত হওয়া, রাগ, ক্রোধ, গ্লানি, অপমানে জর্জরিত হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এ ‘শোক’ সয়ে যাওয়ার জন্য নিজকে কিছুটা সময় দাও—ব্রেক নাও। সময় সব ক্ষতের উত্তম মলম।
৩. তুমি এখন খুবই খারাপ অনুভব করছ। নিশ্চয় চাইবে না ভবিষ্যতেও তেমন খারাপ কিছু ঘটুক। তাই বৃহত্তর প্রেক্ষাপট থেকে ঘটনাটি পুনর্মূল্যায়ন করো, সৃজনশীলভাবে চিন্তা করো, আমি যেমনটি চাই, তেমনটি পেতে হলে আমাকে কী কী করতে হবে?
৪. কোনো একটি ব্যর্থতা দিয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করবে না—ব্যর্থতা একটি ঘটনামাত্র। কোনো মানুষ ব্যর্থ নয়, তার কিছু চেষ্টা, কাজ ব্যর্থ হতে পারে।
৫. যদি তুমি দেখাতে পারো, যেকোনো ব্যর্থতাকে তুমি মোকাবিলা করতে পারো, তাহলে কেউ মনে রাখবে না যে তুমি ব্যর্থ হয়েছিলে।
৬. কিছু ঘটনাকে তুমি এড়িয়ে যেতে পারো না বটে, কিন্তু সেটি কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে এবং এর প্রতি তোমার প্রতিক্রিয়া কী ধরনের হবে, সেটি তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারো।
৭. নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে না—পরিবারের লোক, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে সংযোগ রাখো। গ্লানি, অপমান, কষ্ট চাপিয়ে রাখবে না। প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে থাকো। নিজের ওপর যেমন নির্ভর করবে, তেমনি শুভাকাঙ্ক্ষীদের ওপরও নির্ভর করো।
৮. নিজের যত্ন নাও—যা ভালো লাগে করো, সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে দাও, ভালো ঘুম দাও, পুষ্টিকর খাবার খাও, ব্যায়াম করো। কোথায় ও কার কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে, তার একটি তালিকা তৈরি করো।
৯. আবেগকে ‘বোতলবন্দী’ করে রাখবে না। এগুলো যথাযথভাবে প্রকাশ করো।
১০. ভাবো, তুমি একাই কি হেরেছ? এই হারার জন্য সবাই কি তোমাকে অপছন্দ করছে, অবজ্ঞা করছে, তিরস্কার করছে বা দূরে সরিয়ে দিয়েছে? খেয়াল করলে দেখবে, অনেকেই তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী।
১১. ঘটনাকে ভয়াবহ রূপ দেবে না—কোনোভাবেই আমার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বা নিজেকে অতিরিক্ত দোষারোপ করবে না।
১২. এত ভগ্নমনোরথ অবস্থায়ও আশাবাদী হও। আশঙ্কা, ভীতির দিকে নজর না দিয়ে যা অর্জন করতে চাও, তার একটি ইতিবাচক মন-ছবি তৈরি করো।
১৩. ব্যর্থতার কারণ নিয়ে ভাবো—যা ঘটেছে, বিস্তারিত সব লেখো, সম্ভাব্য সমাধান কী, খুঁজে বের করো ও কী কী বাধা আসতে পারে, তা-ও লেখো।
১৪. ঘটনার পরও জীবন চলবে—ব্যর্থ হয়েছ, তার মানে কেয়ামত হয়ে যায়নি। জীবন-জগৎ আগের মতোই চলবে। তুমি পরিবর্তিত হবে, জীবন পরিবর্তিত হবে—কিছুই এক রকম থাকবে না। একই রকমভাবে তোমার এই দুঃসময়ও দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সামনে তাকাও, উঠে দাঁড়াও, অল্প করে হলেও চলতে থাকো।
১৫. অনলাইনে বিভিন্ন পেজে মানসিক সহায়তামূলক লেখা থাকে, সেগুলো পড়ে দেখতে পারো।
তাজুল ইসলাম: সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।