হজরত আবুবকর সিদ্দিক রাজিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক জমিনের বুকে আল্লাহর ছায়া। যে বিশ্বস্ততার সঙ্গে নিজের কল্যাণের জন্যে অথবা আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণের জন্যে কাজ করবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়ায় তাঁকে স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না। আর যে তার নিজের ব্যাপারে বা আল্লাহর বান্দাদের ব্যাপারে খেয়ানত করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন। ন্যায়পরায়ণ শাসকের জন্য প্রতিদিন ষাটজন সিদ্দিকের সমান আমল আসমানে ওঠানো হয় এবং সেই সিদ্দিকদের প্রত্যেকেই হচ্ছেন আবেদ ও মুজতাহিদ।'
সুলতান সালাহউদ্দিন ছিলেন ন্যায়পরায়ণ মহানুভব দয়াশীল এবং শক্তিমানের বিরুদ্ধে দুর্বলকে সাহায্যকারী।
বিচারকাজের জন্য তিনি প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার সাধারণ দরবারে বসতেন। বিজ্ঞ আইনবিদ, কাজীগণ এবং ওলামায়ে কেরাম সেখানে উপস্থিত থাকতেন। সকল বিচারপ্রার্থীর জন্য দরবার উন্মুক্ত করে দিতেন, যেন প্রত্যেক ছোটবড়ো, যুবকবৃদ্ধ, নারীপুরুষ ও মান্যগণ্য বয়োবৃদ্ধ মানুষ তাঁর দরবার পর্যন্ত পৌছতে পারে। নগরে অবস্থান বা সফরকালীন সর্বাবস্থায় তিনি এটি বজায় রাখতেন। এছাড়াও তিনি প্রতিদিনই তাঁর দরবারে যে সকল অভিযোগ আসত, নিজ হাতে সেগুলো গ্রহণ করতেন এবং তার একটি তালিকা রাখতেন। তাঁর দরবারে ইনসাফের দরজা ছিল সবার জন্য অবারিত। যারা তাঁর কাছে অভিযোগ নিয়ে আসতেন বা অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করতেন, তিনি কখনো তাদের নিরাশ করতেন না। প্রত্যহ দিনের বেলা অথবা রাতে তাঁর সেক্রেটারির সঙ্গে কিছু সময় বসতেন এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি আবেদনপত্রের একটি জবাব লিখে দিতেন।
কখনোই কোনো আবেদনকারী, ঋণগ্রস্ত বা সাহায্যপ্রার্থীকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না । এতসব ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি সর্বদা আল্লাহর জিকির ও কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন।
তিনি প্রজাদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। দীনের সাহায্য ও প্রতিরক্ষায় সদাপ্রস্তুত। সর্বদা কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন। কোরআনের জ্ঞান সম্পর্কে ছিলেন সুপণ্ডিত। সর্বদা কোরআনের নির্দেশনা মেনে চলতেন। কখনোই কোরআনের নির্দেশনাকে পাশ কেটে যেতেন না।
চলার পথে কেউ সাহায্য চাইলে তার আবেদন শোনার জন্য থেমে যেতেন। সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্য তদন্তের ব্যবস্থা করতেন।
আমি নিজে ইবনে জুহাইর নামের দামেস্কের এক ব্যক্তিকে দেখেছি, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তকিউদ্দিনের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে নালিশ দিয়ে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন। যদিও তকিউদ্দিন ছিলেন সুলতানের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র এবং তাঁর দরবারে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী মানুষদের একজন।
তথাপি ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুলতান তাঁকে ছাড় দেননি। তিনি তকিউদ্দিনকে বিচারসভায় উপস্থিত হতে বললেন।
এর চেয়েও আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, যেটি ন্যায়বিচারের প্রতি তাঁর উচ্চ ধারণাকে আরো জোরালোভাবে প্রকাশ করে। এ ঘটনা সুলতানের সঙ্গে ওমর খালাতি নামের এক ব্যবসায়ীর। একদিন আমি কুদস শরিফে আদালতসভায় উপবিষ্ট ছিলাম। এ সময় দেখতে পেলাম, আদালতকক্ষে একজন সুদর্শন বৃদ্ধ প্রবেশ করেছেন। প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। মানুষের কাছে ওমর খালাতি নামে সুপরিচিত। তিনি একটি প্রত্যায়িত স্মারক খুলে তা পাঠ করার আবেদন করলেন। আমি তাঁর কাছে বিবাদীর পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, আমার মামলাটি সুলতানের সঙ্গে। তিনিই আমার বিবাদী। এটি ন্যায়বিচারের আসন। আমরা শুনেছি, আপনিও পক্ষপাত করেন না। আমি বললাম, তাঁর বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ কী? তিনি বললেন, সানকার খালাতি নামে আমার একজন মামলুক (দাস) ছিল। আমৃত্যু সে আমারই মালিকানাধীন ছিল। মৃত্যুর সময় সে বিস্তর সম্পত্তি রেখে যায়। আইন অনুযায়ী তার সম্পত্তিগুলো আমারই পাওয়ার কথা। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সুলতান তার সম্পত্তি হস্তগত করেন। এখন আমার দাবি হলো, সুলতান যেন উক্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন।
আমি তাঁকে বললাম, আপনি এ দাবি উত্থাপনে এত বিলম্ব করলেন কেন? তিনি বললেন, পাওনা বস্তুর দাবি উত্থাপনে বিলম্ব করলে তা স্বত্ব রহিত করে না। এই প্রত্যায়িত স্মারক প্রমাণ করে যে, সানকার খালাতি আমৃত্যু আমার মালিকানাতেই ছিল। আমি তাঁর কাছ থেকে প্রত্যায়িত স্মারকটি নিয়ে পড়ে দেখি, তাতে সানকার খালাতি সম্পর্কিত বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ আছে যে, আরজিশে (আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত) তার মনিব তাকে একজন বণিক থেকে অমুক বছর অমুক মাসের অমুক দিন ক্রয় করেছে। নির্দিষ্ট একটি বছর পর্যন্ত সে তার মালিকানাতেই ছিল। এর পর সে তার মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে চলে যায়। তবে দলিলে উল্লিখিত সাক্ষীগণ কখনোই অবগত হতে পারেননি যে, উক্ত ক্রীতদাস তাঁর মালিকানা থেকে কখন কীভাবে বের হয়েছে।
স্মারকটি পড়ে আমি বিস্মিত হলাম। আমি খালাতিকে বললাম, বিবাদী পক্ষের উপস্থিতি ব্যতীত মামলার রায় দেওয়া সঙ্গত নয়। আমি সুলতানকে বিষয়টি অবগত করব এবং তাঁর বক্তব্যও আপনাকে জানাব । আমার কথায় তিনি সম্মত হলেন এবং চলে গেলেন।
ওই দিনই সুলতানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলে বিষয়টি তাঁর সামনে পেশ করলাম। তিনি বিষয়টি নিতান্তই অসম্ভব মনে করলেন। আর বললেন, আমি প্রত্যায়িত স্মারকটি দেখেছি। আমি বললাম, সেটি আমিও পড়েছি। তাতে দেখলাম, দামেস্কে উক্ত ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদিত হয়েছে।
দামেস্কের প্রত্যায়িত স্মারকপত্রে ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কিত চুক্তি লিপিবদ্ধ। সাক্ষী হিসেবে দামেস্কের কয়েকজন সুপরিচিত ব্যক্তি তাতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি বললেন, ভালো, আমরা লোকটিকে উপস্থিত করে এ বিষয়ে আইনগত নিষ্পত্তিতে যাব। শরিয়ত মোতাবেক বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। এর কিছুদিন পর সুলতানের সঙ্গে আমার একাকী বসার সুযোগ হয়। তাঁকে বললাম, উক্ত বাদী বারবার আসছে। তার দাবি আমাদের শোনা দরকার। তিনি বললেন, তার দাবি শোনার জন্য আমার পক্ষ থেকে একজন উকিল ঠিক করুন। এরপর সাক্ষীরা সাক্ষ্য পেশ করবেন। লোকটি উপস্থিত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্মারকটি খুলবেন না। আমি তা-ই করলাম। সুলতান লোকটিকে ডেকে এনে তাঁর পাশে বসালেন। আমি তাঁর পাশে ছিলাম। এরপর সুলতান স্বীয় আসন থেকে নেমে এসে লোকটির সম-স্তরে বসলেন এবং বললেন, আপনার যদি কোনো দাবি থেকে থাকে সেটি উল্লেখ করুন।
লোকটি প্রথমবারের মতোই তার দাবি উপস্থাপন করল। সুলতান তার দাবির উত্তরে বললেন, উক্ত সানকার লোকটি আমার দাস ছিল।। আজাদ করে দেওয়া পর্যন্ত সে সর্বদা আমার মালিকানায়ই ছিল। এরপর সে মারা যায় এবং তার ওয়ারিশদের জন্য সম্পত্তি রেখে যায়। লোকটি বললেন, আমার হাতে দাবির পক্ষে প্রমাণ আছে। আমার দাবির পক্ষে তা সাক্ষ্য দেবে। লোকটি তার প্রত্যায়িত স্মারকটি খোলার আবেদন করলেন। আমি স্মারকটি খুলে তার দাবি অনুযায়ী লিখিত পেলাম। সুলতান স্মারকে উল্লিখিত দিন তারিখের কথা শুনে বললেন, আমারকাছে এমন লোক আছে, যারা সাক্ষ্য দেবে যে, উক্ত সানকার ওই তারিখে মিশরে আমার মালিকানায় আমার কবজায় ছিল। আমি ওই তারিখের একবছর আগে অন্য আটজন মামলুকের সঙ্গে তাকেও ক্রয় করেছি। তাকে আজাদ করে দেওয়া পর্যন্ত সে আমার কবজায় আমার মালিকানায় ছিল। সুলতান একদল নেতৃস্থানীয় আমির ও মুজাহিদকে উপস্থিত করলে তাঁরা তাঁর বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য পেশ করলেন।
তাঁরা ঘটনাটি সেভাবেই উল্লেখ করলেন, যেভাবে সুলতান উল্লেখ করেছেন। তারিখও সুলতানের দাবি অনুযায়ী যথাযথ। এতে লোকটি নিরুত্তর হয়ে গেল।
আমি সুলতানকে বললাম, মহামান্য সুলতান, লোকটি সুলতানের অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় এমনটি করেছেন। তিনি সুলতানের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। নিরাশ হয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে তার ভালো লাগবে না। তিনি বললেন, সে অন্য বিষয়। অতঃপর তাকে একটি সম্মানসূচক পোশাক এবং বেশ কিছু অর্থ প্রদান করলেন। কী পরিমাণ অর্থ সুলতান তাকে দিয়েছিলেন এ মুহূর্তে তা ঠিক আমার মনে নেই।
বইঃ মহাবীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবি
লেখকঃ কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ
মূল্যঃ ৩৮০৳