জগতে আপনি যা কিছুই বিক্রি করতে চান না কেন, আপনার বিক্রির জায়গা লাগবে। শুধু জায়গাই যে লাগবে তা নয়, মালামালের আনা নেয়ার যে সাপ্লাই চেইন, তা ঠিক থাকা লাগবে।
এখন ধরেন, আপনি ব্যবসা করেন, কিন্তু আপনার মালামালের যে সাপ্লাই লাইন, তা হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা। এতবড় সাপ্লাই লাইনের বিভিন্ন জায়গায় বিপদ আপদ থাকবে তা জানা কথা। দেখা যাবে, এই সাপ্লাই লাইনের বিভিন্ন জায়গাতে দস্যু-ডাকাতদের আস্তানা। আপনি তিন হাজার কিলোমিটার জাহাজ চালিয়ে বা উট চালিয়ে যে মাল নিয়ে এসেছেন, মুহুর্তেই তা কেড়ে নিয়ে গেছে ডাকাতরা।
অথবা ধরেন, আপনার যে মালের ক্যারাভান, সেটায় রাতের বেলা শত্রুপক্ষের কেউ এসে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল, অথবা দেখা গেল আপনি যেখান থেকে মাল কেনেন, সেই বাজারে গিয়ে রাহাজানি করে বলে আসলো, আপনার কাছে মাল বিক্রি করা যাবে না।
এই সমস্ত প্র্যাকটিক্যাল প্রবলেমের মুকাবিলার জন্যই মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রাজনীতি ও সামরিকতা চলে আসে। বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন সুবিচার ও নিরাপত্তা, সুবিচার ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সুশাসনের রাজনীতি। তাই দেখা যায়, বণিকদের সাথে অবধারিতভাবেই সম্রাটদের সম্পর্ক থাকতে হয়। রাজনীতি ছাড়া ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কোনকালে সম্ভব হয় নি, ১৫০০ সালের আশেপাশেও সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে ভাস্কো দ্যা গামার হিন্দুস্তান অভিযানের পর মসলার সওদা ঘিরে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সেটা রীতিমত তুঙ্গে উঠলো।
ভাস্কো দ্যা গামা হিন্দ-আরব মহাসাগরের উন্মুক্ত নীল জলরাশিতে প্রথমবারের মত নিয়ে এসেছিলেন বারুদের ফুলকি। পর্তুগীজ বন্দুক আর কামানের উপস্থিতিতে মাত্র এক বছরের মধ্যে পুরোপুরি অনিরাপদ হয়ে পড়ে মসলার সওদার প্রাচীন জলপথ।
ভাস্কো দ্যা গামার প্রথম আরমাডার পর আরো পর্তুগীজ আরমাডা এসে হাজির হয় ক্যাব্রাল-আলমেইদার নেতৃত্বে। তারা রীতিমত হাতে কলমে দেখিয়ে দেন, গানপাউডার টেকনোলজির সামনে প্রাচীন টেকনোলজি কত অসহায়। মাত্র দুই হাজার পর্তুগীজকে যুদ্ধে হারানোর জন্য ত্রিশ হাজার হিন্দুস্তানী সৈনিকও হয়ে পড়ে অপর্যাপ্ত। ক্যাব্রালের বোম্বিং সামলাতে না পেরে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয় কালিকটের সামুথিরিকে। আরব মুসলিম সওদাগরদের জাত্যাভিমানে বড় রকম আঘাত হানে পর্তুগীজরা, ইসলামের অভ্যুদয়ের পর ইতিহাসে দ্বিতীয়বারেরমত মুসলিমরা অনুভব করতে সক্ষম হয়, তাদের চেয়েও শক্তিশালী জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে।
কালিকটে পর্তুগীজদের গোলন্দাজীর ফলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্ক। আরবদের মসলার সওদাগরি চাঙ্গে উঠলো, সেই সাথে আরব-হিন্দ মহাসাগর জুড়ে যে হাতির দাত, সোনা ও মনিমুক্তার ব্যবসা, তার ভবিষ্যতও পড়লো হুমকির মুখে।
মসলা ছিল সেকালের ফার্মাসিউটিক্যালস।
আপনি কল্পনা করুন, আজকের পৃথিবীতে হঠাৎ কোন একদিন সমস্ত ওষুধের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানরা কি করবেন??
££££
স্বাভাবিকভাবেই ১৫০০ সালের পৃথিবীর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘুম হারাম হয়ে গেল। এই ঘুম হারাম হওয়া নেতাদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন দক্ষিন হিন্দুস্তানের রাজা, মামলুক সুলতান এবং ভেনিসের দোজে।
সেকালের দুনিয়ার প্রধান তিন সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের একটা নিয়ন্ত্রন করতো উসমানী সালতানাত, বাকি দুইটা নিয়ন্ত্রন করতো মামলুক সালতানাত।
এই তিনটা জলপথের মধ্যে প্রথমটাই ছিল জাযিরাতুল আরবের সাথে হিন্দুস্তানের বানিজ্য। দ্বিতীয়টা ছিল লোহিত সাগর হয়ে সোয়াহিলি উপকূল-মিসর-শামের বাণিজ্য, আর তিন নম্বরটা ছিল সাইপ্রাস-ক্রিট-কৃষ্ণসাগর হয়ে ভুমধ্যসাগরীয় উপকূল বাণিজ্য।
প্রথম দুই পথ ছিল মামলুকদের হাতে, তিন নম্বর পথের অর্ধেকটা তখন উসমানীদের হাতে, বাকি অর্ধেক কমবেশি ভেনিস-জেনোয়াই নিয়ন্ত্রন করতো, তবে নব্য নৌশক্তি হিসেবে স্পেন-পর্তুগাল-ফ্রান্সের উত্থানের পর তাদেরও একটা স্টেক এখানে যোগ হয়। মূলত, এদের সবার ওপর ছড়ি ঘোরাতো ভ্যাটিক্যান। ভূমধ্যসাগরের আধিপত্যের দ্বন্দটা পরিনত হয় পোপ বনাম সুলতানের দ্বন্দে।
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রনের কিছু মৌলিক শর্ত আছে, যেগুলো কোন রাজনৈতিক শক্তিকে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রনের সক্ষমতা দেয়।
১)উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন
২)বাজার নিয়ন্ত্রন
৩)পরিবহন ও বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রন ও
৪)মুদ্রাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন
ষোড়শ শতকের রাজনীতিতে মসলার বাণিজ্যের উৎপাদনকেন্দ্র ছিল দক্ষিণ ভারত আর ইন্দোনেশিয়া, বাজার ছিল সারা পৃথিবী, বিশেষভাবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য, আর পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল হিন্দুস্তান থেকে আরবে যাওয়ার সমুদ্রপথ। একবার আরবে পৌছালে কোন না কোন পথে তা ইউরোপে পৌছাবেই।
আর এই পথগুলোতে থাকা সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির সাথে সুসম্পর্ক রাখতো ভেনিস ও জেনোয়ার বনিকেরা। বিশেষভাবে মামলুক সুলতানের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল শতাব্দী প্রাচীন। ভেনিসের সাথে মামলুকদের বাণিজ্য ছিল এমন এক বাণিজ্য সম্পর্ক যা ঘোর ক্রুসেডেও বন্ধ হত না।
ইউরোপে মসলার ব্যবসাটা ছিল প্রায় একচেটিয়া ভেনিসের ব্যবসা, আর এর প্রধান কারনও মামলুকদের সাথে তাদের সুসম্পর্ক, যেটা জেনোইজরা সেভাবে রাখতে পারে নি।
ভেনিসে ভেড়া মসলা বোঝাই জাহাজ থেকে মসলা যেতো আন্দালুসিয়ায়, সেখান থেকে পর্তুগালে। যেত প্যারিসে, আমস্টারডামে, সেখান থেকে লন্ডন আর হামবুর্গ, ভিয়েনায়। উসমানীদের কাছেও মসলা আসতো ভেনিশীয়ানদের হাত হয়ে। বলা যায়, মসলার সওদায় একপ্রকার কন্টিনেন্টাল মনোপলি পেয়ে গেছিল ভেনিস।
ভাস্কো দ্যা গামার হিন্দুস্তান অভিযান সফল হওয়ার পর ভেনিস বুঝতে পারে, এই একচেটিয়া ব্যবসাটা তাদের হাত থেকে স্থায়ীভাবে হাতছাড়া হয়ে যাবে যদি না পর্তুগীজদের থামানো যায়। যেহেতু ট্রিটি অফ তরদেসিলাসের কারনে স্প্যানিশরা হিন্দুস্তান অভিযান করবে না, তাই পর্তুগীজদের থামাতে পারলেই বাকি পথ মসৃণ।
ভেনিশীয়ানরা নিজেদের বলতো, প্রথমে বণিক, এরপর খ্রিস্টান। বিষয়টা বাস্তবিকই তাই ছিল।
১৪৯৯ সালে ভাস্কো দ্যা গামা যখন দক্ষিণ হিন্দুস্তানের খোলা সাগরের রোদে পুড়ছিলেন, তখন ভেনিস যুদ্ধ করছে লেপান্তোয়, কামাল রইসের উসমানী নৌবহরের সাথে ফার্স্ট ব্যাটল অফ লেপান্তোয়।
সেই যুদ্ধে তারা সফলভাবে টেনে নিয়ে আসে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও পর্তুগীজদের, কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে ভেনিশীয়ানদের সেনাচালনার অদক্ষতায় ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ও পর্তুগীজরা ময়দান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ শেষ হবার পরপর যখন ভেনিস জানতে পারলো যে পর্তুগীজরা হিন্দুস্তান যাবার পথ পেয়ে গেছে, তারা ভোল পালটে ফেললো।
রাতারাতি মামলুক সুলতানের দরবারে ভেনিসের দুত তদবীর শুরু করলো, যেন মামলুকরা আরব-হিন্দ মহাসাগরে পর্তুগীজ আরমাডার চলাচল বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেই সামর্থ্য মামলুকদের ছিল না।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মামলুকরা নিজেদের সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভুত করেছে সিজ ওয়ারফেয়ার আর ক্যাভালরিতে, জোরদার নৌবাহিনী কখনো তাদের হিসাবেই ছিল না।
১৫০২-১৫০৪ সালের মধ্যে পর্তুগীজরা হয়ে ওঠে আরব সাগরের অপ্রতিরোধ্য শক্তি, এসময় তারা কমপক্ষে দেড় ডজন মিসরীয় জাহাজ ডুবিয়ে/পুড়িয়ে দেয় বা লুট করে। কয়েকশো হজ্বযাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে ডুবিয়ে দেয়া হয় আরব সাগরে।
উসমানীরা জাহাজ, কারিগর ও কাঠ দিয়ে মামলুকদের কাছে সাহায্য পাঠায় বটে, কিন্তু মামলুকদের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল এমন এক জাতির সাথে, যারা সমুদ্রের সাথে লড়াই করে কাটিয়ে এসেছে গোটা এক শতাব্দী। ধীরে ধীরে এমনকি লোহিত সাগরেও ঢুকে পড়লো পর্তুগীজ আরমাডা। ভেনিস-মামলুক-অটোমানদের হাত থেকে মসলার ব্যবসা তো ছুটে গেলোই, সাথে সাথে সমুদ্রপথে হজ্বযাত্রাও বন্ধ হওয়ার যোগাড় হল।
মামলুকদের কোষাগার খালি হয়ে যেতে লাগলো একেবারেই।
এভাবে আর চলে না।
বাধ্য হয়েই তাদের নৌবাহিনী নামাতে হল, অন্তত জেদ্দা আর ইয়েমেন রক্ষায়, কারন পর্তুগীজদের পরের টার্গেট ছিল কা'বা।
- Muhammad Sajal