উনিশ'শ বাহাত্তর সালের ৮ই জানুয়ারী। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে মাত্রই লণ্ডনে পৌঁছেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেখান থেকে ১০ই জানুয়ারি ঢাকা রওনা হওয়ার আগেই তিনি জানতে চাইছিলেন, "নুরুল ইসলাম কোথায়? ওকে খবর দাও।"
ঢাকায় জরুরী বার্তা গেল, তিনি এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত যেন নুরুল ইসলাম অপেক্ষা করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান যার খোঁজ করছিলেন, সেই নুরুল ইসলাম তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের একজন। হার্ভাডে পড়াশোনা করা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তখন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংকের একটি চাকুরিতে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
"আমি তখন ঢাকায় ফিরেছি আমার পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যাওয়া হলো না। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, আপনাকে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব নিতে হবে," নুরুল ইসলাম বলেন।
মাত্র ৪২ বছর বয়সে অধ্যাপক ইসলামের ওপর এমন এক বিরল কাজের দায়িত্ব পড়লো, বিশ্বের খুব কম অর্থনীতিবিদেরই যা করার সুযোগ ঘটে। একেবারে শূন্য থেকে একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের অর্থনীতি পুর্ননির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে তাকে।
"ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসনের দাবি যখন বঙ্গবন্ধু তুলছেন, তখন আমি তার উপদেষ্টাদের একজন। উনিশ'শ উনসত্তর সাল থেকে দিনরাত কাজ করেছি এই ছয় দফার ওপর। পূর্ব পাকিস্তান যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার, সেটি তুলে ধরা ছিল আমাদের কাজ।"
অধ্যাপক ইসলাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবসর জীবনযাপন করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির যাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছিল, বিবিসি বাংলার কাছে এক দীর্ঘ টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তার স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের বাকী তিন সদস্য হিসেবে তিনি যাদের নিয়ে এসেছিলেন, তারা ছিলেন সেসময়ের বাংলাদেশের খ্যাতিমান তিন তরুণ অর্থনীতিবিদ: রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান এবং মোশাররফ হোসেন।
"আমি গর্ব করে বলতে পারি, পরিকল্পনা কমিশন ছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারী সংস্থা, যেখানে আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং মেধাবী মানুষদের এনে জড়ো করেছিলাম" বলছিলেন অধ্যাপক ইসলাম।
বিশ্বব্যাংকের নেতিবাচক রিপোর্ট
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম যে রিপোর্টটি পেশ করে, তার শুরুতে একজন গড়পড়তা বাংলাদেশির জীবন সম্পর্কে এরকম বর্ণনা দেয়া হয়েছিল:
"বাংলাদেশের আশি ভাগ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত, একজন গড়পড়তা কৃষকের জমি আছে দেড় একর, সে গ্রামের ধনী কারও কাছ থেকে আরও এক একর বর্গা নেয়। তার আছে একটি রুগ্ন গরু, যেটি দিয়ে সে হালচাষ করে। তার একমাত্র সম্পদ হচ্ছে সারা বছর খাওয়ার জন্য যে ধান সে মওজুদ রাখে। অন্য যে কোন উৎসব বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য তাকে হয় আত্মীয়-স্বজন, অথবা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার করতে হয়। যেহেতু তার নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাই কোন রকমে সুদটাই সে শোধ করতে পারে, আসল আর শোধ করা হয় না।"
বাকী দুনিয়া তখন বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছিল, বিশ্বব্যাংকের এই রিপোর্টে তারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডঃ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন। উনিশ'শ তিয়াত্তর সালে তিনি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব।
"বিশ্ব ব্যাংকের প্রথম রিপোর্ট ছিল খুবই নেতিবাচক। এরপর জনসন বলে একজন আমেরিকান কূটনীতিক, তিনিও বলেছিলেন এই রাষ্ট্র বেশিদিন টিকবে না, এটি হবে একটি ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস। এই কূটনীতিকের কথাকেই ভুলভাবে হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর মন্তব্য করেছিলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি জাস্ট ফালেন এবং তার এক সহযোগী। তারা লিখেছিলেন এটার জিওগ্রাফি ঠিক আছে, কিন্তু অর্থনীতি ঠিক নেই। এই দেশের অর্থনীতি টেকসই করতে দুশো বছর সময় লাগবে।"
বিশ্ব ব্যাংকের সেই বহুল উদ্ধৃত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের যদি উন্নয়ন সম্ভব হয়, আফ্রিকা-সহ বিশ্বের যে কোন দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এবং তার সহকর্মীরা ঢাকায় সচিবালয়ে তাদের দফতরে কাজ শুরু করে দিলেন। কমিশনের তিন নম্বর সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমান ফেব্রুয়ারীর ৭ তারিখে তার সহকর্মীদের কাছে একটি নোট পাঠালেন।
"মুক্তিযুদ্ধে আমরা জিতেছি। এখন দ্বিতীয় যুদ্ধ: পুনর্বাসন ও পুর্নগঠন, অর্থনীতি আবার চালু করা, মানুষের অন্নের সংস্থান করা।"
অধ্যাপক আনিসুর রহমান এখন ঢাকায় নিভৃত জীবনযাপন করছেন। তিনি আমার সঙ্গে দীর্ঘ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পরিকল্পনা কমিশনে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক কথা বললেও কোন আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি তার স্মৃতিকথা "পথে যা পেয়েছি" বইতে লিখেছেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রশাসনের মধ্যে যে সংকল্প তখন দরকার ছিল, তা দেখা যায়নি।
অর্থনীতি পুনর্গঠনে নতুন সরকারের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দর চালু করা। কারণ যুদ্ধের সময় এই দুটি বন্দরেই যেভাবে মাইন পাতা হয়েছিল, তাতে সেগুলো জাহাজ চলাচলের জন্য খুবই বিপদজনক অবস্থায় ছিল। বন্দরের চ্যানেলগুলোতে ছিল অনেক ডুবে যাওয়া জাহাজ।
এরকম এক সময়ে এই দুটি বন্দর চালু করতে জাতিসংঘের সাথে আলোচনা করতে বলা হলো অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে।
"আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য তখন পুরোপুরি বন্ধ, কারণ বন্দর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, আপনি জাতিসংঘের সাথে আলাপ করুন। তিনি চাননি বন্দর মাইনমুক্ত করার কাজে কোন বৃহৎ শক্তি জড়িত হোক। কারণ দেশের নিরাপত্তা নিয়ে তার মধ্যে উদ্বেগ ছিল।"
কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর মাইনমুক্ত করার কাজে জাতিসংঘের সাহায্য পাওয়া যায়নি, সাহায্য এসেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই।
"বঙ্গবন্ধু যখন তার প্রথম সফরে সোভিয়েত ইউনিয়নে গেলেন, তখন আমি সাথে ছিলাম। ওরা বললো, তোমরা কেন চট্টগ্রাম বন্দর চালু করছো না, তোমাদের তো ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। এরপর ভ্লাদিভস্তক থেকে ওরা বিরাট দল পাঠালো চট্টগ্রামে। কাজটা ওরা বেশ দ্রুতই শেষ করেছিল", বলছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম।
সমাজতন্ত্র বনাম বিদেশি সাহায্য
কিন্তু নতুন সরকারের মধ্যে তখন নানা ধরণের আদর্শগত টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে স্পষ্ট করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা আছে, কিন্তু বিদেশি সাহায্যের জন্য মরিয়া বাংলাদেশের ওপর নানা রকম শর্ত চাপিয়ে দিতে চাইছে বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ তখন সদ্য যুদ্ধ ফেরত এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা।
"তখন বাংলাদেশের ছিল পথ বাছাইয়ের প্রশ্ন। আমি কি সমাজতন্ত্রের পথে যাব, নাকি ধনতন্ত্রের পথে হাঁটবো। যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক, এমনকি ভারত পর্যন্ত তখন চায় না, বাংলাদেশ পুরোপুরি সমাজতন্ত্রের পক্ষে যাক। তখন এক বিচিত্র টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ।"
পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান যে জাতীয়করণ করা হবে, সেটা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক ছিল না। কিন্তু গোল বাধলো বিদেশি সাহায্য গ্রহণের প্রশ্নে।
মনে করা হয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার বিরোধী ছিলেন। এরকম এক সময়ে একবার তিনি এবং পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন খাদ্য সাহায্য চাইতে।
"যখন আমরা ওয়াশিংটনে গেলাম, তখন ওরা আমাদের বিরাট লেকচার দিল। বললো, তোমরা পাকিস্তানের সঙ্গে মিটমাট করে নাও। তাজউদ্দিন সাহেব তো রীতিমত শকড। আমরা গেছি সাহায্য চাইতে, ওরা বলে পাকিস্তানের সঙ্গে মিটমাট করে নাও।"
বিশ্বব্যাংকও তখন এমন কিছু বিষয় তুলছিল, যা বাংলাদেশকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এর মধ্যে একটি ছিল, পাকিস্তানকে দেয়া বিশ্বব্যাংকের ঋণের দায়ভাগ নেয়ার প্রশ্ন।
অধ্যাপক ইসলাম বলেন, "ওরা বলছিল, পাকিস্তানকে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, সেটার দায়ভাগ আমাদেরও নিতে হবে। আমরা বললাম, আমরা কেন নেব, ওরা তো আমাদের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে। তখন ওরা বললো, সেটা তোমাদের ইন্টারন্যাল ব্যাপার। আমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।"
শেষ পর্যন্ত ফয়সালা হয়েছিল, বাংলাদেশ কেবল সেই ঋণের অংশই পরিশোধ করবে, যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল ভূমি সংস্কার প্রশ্নেও। কমিশনের সবচেয়ে 'র্যাডিকাল' সদস্য বলে পরিচিত অধ্যাপক আনিসুর রহমানের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ভূমি সংস্কারের একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরির।
অধ্যাপক রহমান তার স্মৃতিকথায় এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। পরিকল্পনা কমিশন থেকে ভূমি মালিকানার সিলিং বেঁধে দেয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয় , সর্বোচ্চ সীমা দশ একর করার প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই এর তীব্র বিরোধিতা করা হয়।
"ক্যাবিনেট থেকে এই প্রস্তাব আর ফিরে আসেনি। দেশের প্রধান খাত কৃষিখাতে প্রগতিশীল সংস্কারের এই প্রস্তাবের নীরব মৃত্যুতে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকার অনুযায়ী সমতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের পথে যাচ্ছে না", নিজের লেখা 'পথে যা পেয়েছি' বইতে এভাবেই এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান।
তিনি আরও লিখেছেন, "শুনেছি তাজউদ্দীন এই প্রস্তাবের পক্ষে প্রবল সুপারিশ করেন, এবং পরে ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে ফিরে এসে এক বন্ধুর কাছে 'ভূমি সংস্কার হলো না' বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।"
প্রথম টাকা ছাপানো হলো যেভাবে
কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন এতটাই সঙ্গীন যে, বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হতে গেলে যে চাঁদা দিতে হবে, সেই অর্থও তহবিলে নেই।
"বাংলাদেশ শুরু করেছিল মাত্র ১৮ ডলার দিয়ে। পাকিস্তানীরা চলে যাওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঢাকা অফিসে রেখে গিয়েছিল ১৮ ডলার। কিন্তু এই অবস্থায় ভারত বিরাট সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। সাহায্য করেছিল সুইডেন এবং কানাডা। এই দুটি দেশ সোনাও দিয়েছিল, ডলারও দিয়েছিল। তারা সোনা দিয়েছিল এই জন্য যে, সোনা না থাকলে টাকা ছাপানো যায় না", বলছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডঃ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন।
এভাবে কিছু বন্ধু রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আইএমএফের সদস্য হলো বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই পাকিস্তানী মূদ্রায় বাংলাদেশের সীল মেরে সেটাকেই বাংলাদেশের মূদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছিল অনেকে। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চে পাকিস্তান সরকার তাদের মূদ্রার নোট অচল ঘোষণা করলো। একই সময়ে বাংলাদেশেও এই মূদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশি নোট ছাপানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
'আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের শেষের দিকে ভারত থেকে এবং ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশি টাকার নোট ছাপিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল", স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন।
বাংলাদেশি মূদ্রা নিয়ে আরেকটি সংকট তৈরি হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর আগের দুবছরে তেলের দাম মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার পর বিশ্বের অনেক দেশেই লাগামহীন মূদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এরকম একটা সময়ে বাংলাদেশে একশো টাকার নোট অচল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার।
"বাংলাদেশে একশো টাকার যত নোট সার্কুলেশনে থাকার কথা, তার দশগুণ বেশি নোট বাজারে চালু আছে বলে সন্দেহ করছিল সরকার", বলছিলেন ডঃ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন।
উনিশ'শ পঁচাত্তর সালের ৮ই এপ্রিল সরকার কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিল একশো টাকার নোট অচল হবে। সেদিন বিকেলেই ঘোষণা দেয়া হবে।
"দুপুরের পর থেকে সংশ্লিষ্ট সবাই বঙ্গবন্ধুর দফতরে আসতে শুরু করেছেন। আমাকে বলা হয়েছে, যারা ভেতরে ঢুকবে, তারা আর বেরুতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আসলেন, অর্থমন্ত্রী মল্লিক সাহেব আসলেন। কেউ টেলিফোনও করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি লাইনেই শুধু কল যাবে, আমি তার টেলিফোন অপারেটর।"
বিকেল তিনটার একটু পর একশো টাকার নোট অচলের ঘোষণা আসলো। কেবল আটশো টাকা পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে বদলে দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো।
কিউবায় পাট রফতানি নিয়ে সংকট
বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য হচ্ছে পাট। নতুন সরকার তখন মরিয়া হয়ে পাট রফতানির চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের কাঁচা পাট মূলত যেত পাকিস্তানের জুট মিলগুলোতে, কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে পাট যাওয়া বন্ধ।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, "এরকম একটা সময়ে কিউবা আমাদের কাছে পাট চাইলো। আমরা সাথে সাথে লুফে নিলাম। কিউবায় বেশ তাড়াতাড়িই পাটের একটা শিপমেন্ট পাঠানো হলো।"
কিন্তু এই ঘটনায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে এক মারাত্মক মূল্য দিতে হয়েছিল।
ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে।
"তিনি আমাকে বললেন, কি করছেন আপনারা? কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করছেন ? আপনারা কী জানেন, আমাদের দেশে আইন আছে, কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করলে সেই দেশে সাহায্য দেয়া যাবে না। কিউবায় এই পাট রফতানি এখনই বন্ধ করতে হবে, নইলে আমরা আপনাদের কোন সাহায্য দিতে পারবো না।"
এটি ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের খুবই সংকটজনক এক মূহুর্ত। দেশজুড়ে এক চরম দুর্ভিক্ষের মধ্যে তখন মার্কিন সরকারের খাদ্য সাহায্য নিয়ে দুটি জাহাজ বাংলাদেশের পথে।
তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ কিউবায় পাট রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল। মার্কিন সরকারকে সেই সিদ্ধান্তের চিঠিও দেয়া হলো। কিন্তু লাভ হলো না বিশেষ।
"মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাকে বললেন, চট্টগ্রাম বন্দরে এখনো কিউবার জন্য একটা শিপমেন্ট পড়ে আছে। সেটা যতক্ষণ বন্ধ না করছেন, ততক্ষণ সাহায্য দেয়া সম্ভব নয়", বলছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম।
এই সংকটের জন্য বাংলাদেশকে যে মূল্য দিতে হয়েছিল, তার পরিণাম ছিল সুদূরপ্রসারী, বলছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন।
"উনিশ'শ চুয়াত্তর সালে বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, আমি মনে করি তার প্রধান কারণ ছিল এটি। এই সাহায্য যে শেষ পর্যন্ত আসেনি, তার সুযোগ নিয়েছিল দেশের মজুতদার এবং কালোবাজারি চক্র।''
তবে পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন।
"এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে, কিন্তু সেই বিতর্ক হচ্ছে রাজনৈতিক বিতর্ক। আসলে তখন কিছু করার ছিল না। কারণ ১৯৭৩ সালে কয়েকবার বন্যা এবং খরা হয়েছে। তখন বিরাট শস্য ঘাটতি দেখা দেয়। এরপর যখন ১৯৭৪ সালের শরৎকাল আসলো, তখন আর দেশে কোন খাদ্যের মওজুদ নেই। সরকারের হাতেও নেই। প্রাইভেট স্টকও নেই।"
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এ এ দুর্ভিক্ষ এড়ানো প্রায় অসম্ভব ছিল।
সেসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার এক সাক্ষাতের ঘটনার উল্লেখ করলেন তিনি।
Nice
ReplyDeleteNice
ReplyDelete